‘একদিন সকালে আপনি ঘুম থেকে উঠে দেখলেন আপনার বিরুদ্ধে ধর্মানুভূতিতে আঘাতের মামলা হয়েছে। কি বিবেচনায় আদালত এধরণের মামলা শোনে?’ সঞ্চালক নূর সাফা জুলহাজের এই প্রশ্ন দিয়েই শুরু হয় সোমবারের একাত্তর জার্নাল।
সংবাদ বিশ্লেষণের এই অনুষ্ঠানে গতকালের অন্যতম আলোচ্য সংবাদ ছিল ব্যান্ডদল মেঘদলের বিরুদ্ধে ধর্মানুভূতিতে আঘাতের মামলার ঘটনাটি। মামলাটি করেন আইনজীবী ইমরুল হাসান। ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মইনুল ইসলামের আদালত মামলার আবেদনের শুনানি নিয়েছেন। শুনানি শেষে পিবিআইকে অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করে আগামী ১ ডিসেম্বর প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশও দিয়েছেন আদালত।
১ নভেম্বর (সোমবার) একাত্তর টেলিভিশনের নিয়মিত আয়োজন একাত্তর জার্নালে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয় সবিস্তরে। নূর সাফা জুলহাজের সঞ্চালনায় এই আলোচনায় যুক্ত হয়েছিলেন সিনিয়র আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না, আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, সংস্কৃতিজন ও মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু এবং জিটিভির প্রধান সম্পাদক, সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা।
আলোচনার শুরুতেই সঞ্চালক নূর সাফা জুলহাজ অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের কাছে প্রশ্ন রাখেন কোন কোন মানদণ্ডের বিবেচনায় আদালত এই মামলা আমলে নিলেন। জবাবে শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক জানান তিনি নিজে মেঘদলের গানটি শুনেছেন এবং তার কাছে মনে হয়নি এই গানে এমন কোন উপাদান আছে যাতে কারো ধর্মানুভূতি আহত হতে পারে। ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কেন এই মামলা আমলে নিলেন তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন আপীল বিভাগের সাবেক এই বিচারপতি।
সিনিয়র আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না বলেন, এই গানে ধর্মের অবমাননা হলে নজরুলের বিদ্রোহী কবিতার ‘খোদার আসন আরশ ছেদিয়া/উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাতৃর’ এখানেও ধর্মের অবমাননা খুঁজে পাওয়া যাবে, এছাড়া ওমর খৈয়াম তাঁর একটি কালজয়ী কবিতায় লিখেছেন ‘এই বেলা সখী পিয়ে নাও সুরা/ঘুমাবার কাল অনেক পাবে/কবর গুহায় পচিবে যখন/বান্ধব সেথা কেহ না রবে’ এসব কিছুই ধর্মানুভূতি আঘাতের ভেতরে পড়বে।
অথচ বিপরীত দিকে ইউটিউব জুড়েই দেখা যায় নারীর প্রতি বিদ্বেষ, ইসলাম ব্যাতিত অন্যান্য ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ, জাতীয় সংগীত বিরোধী শত শত ওয়াজ। এসব নিয়ে কখনো কোন প্রশ্ন ওঠেনা। অন্য দিকে একটি শিল্প হিসেবে দেখলে ‘লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক’ এই লাইনটিতে সুর আরোপে কোন অপরাধ হয়নি।
জিটিভির প্রধান সম্পাদক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা জানান, মেঘদলের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন যেই আইনজীবী সেই একই লোক মামলা করেছিলেন বাউল রিতা দেওয়ানের বিরুদ্ধে। উনিই আবার মামলা করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের প্রফেসর জিয়া রহমানের বিরুদ্ধে। তার দায়ের করা সব মামলাই ধর্মানুভূতির মামলা। মূলত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রয়োগের সুযোগ পেয়েই এক শ্রেণীর মানুষ সুযোগ নিচ্ছেন বলে মনে করেন এই সিনিয়ার সাংবাদিক।
সঞ্চালক নূর সাফা জুলহাজ সংস্কৃতি ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর কাছে প্রশ্ন রাখেন, এভাবে চলতে থাকলে বেগম রোকেয়া, কাজী নজরুল, জয়নুল আবেদীন, জসিমউদ্দিন সহ সবার শিল্প আর সাহিত্যেই তো উগ্র-সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ধর্মানুভূতিতে আঘাত খুঁজে পাবে, এই প্রক্রিয়ায় চলতে থাকলে আমাদের সূফী গান, পালা গান, যাত্রাপালা সবার বিরুদ্ধেই তো মামলা করা যাবে।
নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পরিসর ছোট হয়ে আসাতেই এই সমস্যাটি দেখা দিয়েছে। মেঘদলের গানটি ছিল সবধর্মকে সমন্বয় করে লেখা একটি গান। এই গানের বিরুদ্ধে করা মামলাটি আমলেই নেওয়া উচিত হয়নি। সংস্কৃতির পথকে রুদ্ধ করে উগ্র-মৌলবাদকে প্রণোদনা দিলে মানুষ আরও বেশি অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। সরকারের এখনই এই বিষয়টির দিকে গভীর মনযোগ দেয়া উচিত বলে মনে করেন এই সংস্কৃতি ব্যক্তিত্ব।
সংবাদ বিশ্লেষণের এই অনুষ্ঠানে জলবায়ু সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী যেমন বিশ্ব জলবায়ু পরিস্থিতিকে রেড এলার্ট বলেছেন, তেমনি বাংলাদেশের সংস্কৃতির জগতের পরিস্থিতি নিয়ে মেঘদলের বিরুদ্ধে মামলা অসাম্প্রদায়িক শক্তির জন্য একধরনের রেড এলার্ট মতই নয়-কি? এমন প্রশ্ন তোলেন সঞ্চালক নূর সাফা জুলহজ। সূত্র: একাত্তর টিভি