Homeআন্তর্জাতিকতুরস্ক-পশ্চিমা সম্পর্কের অবনতি কীসের ইঙ্গিত?

তুরস্ক-পশ্চিমা সম্পর্কের অবনতি কীসের ইঙ্গিত?

চলতি বছর তুরস্কের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আগামী মে মাসেই দেশটিতে পার্লামেন্ট ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। আবার এ বছরেই পূর্ণ হবে বহুল আলোচিত লুজান চুক্তির ১০০ বছর।

এরই মধ্যে তুরস্কের রাজনীতির মাঠ ধীরে ধীরে গরম হতে শুরু করেছে। ৬ দলীয় জোট তাদের আগামী সরকারের রূপরেখা ও নির্বাচনী ইশতেহারঘোষণা করেছে।

প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানের বিরুদ্ধে যাকে মাঠে নামানোর কথা ভাবা হচ্ছে আগামী সপ্তাহেই (১৩ ফেব্রুয়ারি) ঘোষণা করা হবে তার নাম। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, তারপরই দেশটির রাজনীতির মাঠ টগবগ করেফুটতে থাকবে।

এদিকে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে আঙ্কারার সম্পর্ক ক্রমেই অবনতি হচ্ছে। এফ-১৬ যুদ্ধবিমান নিয়ে গত কয়েক বছর ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা করে আসছিল তুরস্ক।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, ওয়াশিংটন যে আঙ্কারাকেএফ-১৬ যুদ্ধবিমান দেবেনা তা মোটামুটি নিশ্চিত।এদিকে তুরস্কের সামরিক খাতে আরও কিছুনিষেধাজ্ঞা দেয়ার পরিকল্পনা করছে যুক্তরাষ্ট্রসহ কিছুপশ্চিমা দেশ।

তুরস্কেরবায়রাকতার ড্রোনের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়ারকথা বলছে জোরেশোরেই। সেই সঙ্গে রাশিয়ার সঙ্গেসম্পর্ক ছিন্ন না করলে তুরস্কেরওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দেয়া উচিৎ বলেকিছু পশ্চিমা দেশ ইইউকে পরামর্শদিচ্ছে।

এদিকে সুইডেন, ডেনমার্ক ও নেদারল্যান্ডসে পবিত্রকুরআন পোড়ানোর ঘটনার রেশ ধরে আঙ্কারসঙ্গে পশ্চিমের সম্পর্ক ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে।  তুরস্কে সন্ত্রাসী হামলা হতে পারে বলেকয়েকদিন আগেই সতর্কতা জারিকরেছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডা। শুধুতাই নয়, নিজ নিজদেশের নাগরিকদের তুরস্ক ভ্রমণের ব্যাপারে সতর্ক করেছে।

সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হলো, সন্ত্রাসী হামলাহতে পারে, এমন সতর্কতার পরযুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য নেদারল্যান্ডস তুরস্কে অবস্থিত কূটনৈতিক মিশন (দূতাবাস/কনস্যুলেট) বন্ধ করে দিয়েছে।এমনকি ইস্তাম্বুলে ফ্রান্সের মালিকানাধীন একটি কলেজও বন্ধকরে দেয়া হয়েছে।

শুধু তাই নয়, তুরস্কের পশ্চিমেগ্রিস ও তুরস্কের মাঝেএজিয়ান সাগগরে বিমানবাহী রণতরী পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। গত কয়েক বছরধরেই এই গ্রিস, গ্রিকসাইপ্রাস ও সিরিয়ার সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো ব্যাপক অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সজ্জিত করছে।

একই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ দুই নির্বাচন ও লুজান চুক্তির শেষ হওয়ার বিষয়টি সামনে রেখে এসব ঘটনা কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে, তা নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব ঘটনার মধ্যদিয়ে তুরস্কের আকাশে কালবৈশাখী ঝড়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

দেশটির পশ্চিমা আকাশের কোণে যে কালোমেঘজমাট বেধে তা এখনজানান দিতে শুরু করেছে।ঠাণ্ডা বাতাস বইতে শুরু করেছে।সে বাতাসের তীব্রতাও ক্রমেই বাড়ছে। এটা এখন শেষ পর্যন্ত বিশালকোনো কালবৈশাখী ঝড়ে রুপ নেবেনাকি নির্বাচন পর্যন্ত তা কালোমেঘ হয়েইথাকবে এখনই বলা যাচ্ছেনা। তবে এটা যেশুভলক্ষণ না তা নিশ্চিত।

তুরস্কে ইউরোপীয় দেশগুলোর কনস্যুলেট বন্ধ

সম্প্রতি আঙ্কারা সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের ন্যাটোসদস্যপদ প্রস্তাবে ভেটো দেয়ার পরথেকে তুরস্ক ও পশ্চিমা দেশগুলোরমধ্যে উত্তেজনা বাড়ছিল। এরপর সুইডেন, ডেনমার্ক ও নেদারল্যান্ডসে পবিত্রকুরআন পোড়ানোর ঘটনার জের ধরে পশ্চিমের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক ক্রমেই শীতল হচ্ছে।

এছাড়া পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোয় সুইডেনও ফিনল্যান্ডের যোগ দেয়া নিয়েও তুরস্কেরসঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলোর বিরোধ দেখা দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ফিনল্যান্ডের ন্যাটোয় যোগ দেয়ার বিষয় রাজি থাকলেওসুইডেনের বিষয়ে আপত্তি তুলেছেন। তুরস্ক ভেটো দিলে ন্যাটোয়সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের যোগদানআটকে যাবে।

এই পরিস্থিতিতে তুরস্ককে চাপ দেয়ার কৌশল বেছে নিয়েছে পশ্চিমারা। মূলত এ কারণে সন্ত্রাসী হামলার ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে গত বুধবার (১ ফেব্রুয়ারি) জার্মানি, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশ ইস্তাম্বুলে তাদের কনস্যুলেট বন্ধ করে দেয়।

এর প্রতিক্রিয়ায় বৃহস্পতিবার (২ ফেব্রুয়ার) নয়টি দেশের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে তুরস্ক।আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদন মতে, জার্মানি, বেলজিয়াম, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড, সুইডেন ও যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতদেরপররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডাকা হয়।

তুরস্কের পার্লামেন্ট ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পাশাপাশি লুজান চুক্তির ১০০ বছর পূর্ণ হওয়া ঘটনা সামনে রেখেছেন পশ্চিমের সঙ্গে আঙ্কারার সম্পর্কের অবনতি হওয়ার বিষয়টিকে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। 
 
পার্লামেন্ট প্রেসিডেন্ট নির্বাচন

তুরস্কে আগামী ১৪ মে পার্লামেন্টও প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হবে বলে ইতোমধ্যে ঘোষণা করেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। গত মাসে (২১ জানুয়ারি) উত্তরপশ্চিম তুরস্কের বুরসায় এক যুব সম্মেলনেএ ঘোষণা দেন তিনি।

প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বলেন, ‘নির্বাচন হবে ১৪ মে। আমি সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ দিচ্ছি, তার পূর্বনির্দিষ্ট পথেআমরা হাঁটছি। আমাদের যে যুবরা এবারভোটাধিকার পেয়েছেন, তাদের জানিয়ে দিতে চাই, নির্বাচনহবে ১৪ মে। তখনতারা ভোট দিতে পারবেন।’

এরদোয়ান জানান, আগামী ১০ মার্চ তিনিচূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করবেন। এরপর তুরস্কের সুপ্রিমইলেকশন কাউন্সিল নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করবে।যদি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কোনো প্রার্থী ৫০শতাংশ ভোট না পান, তাহলে ২৮ মে দ্বিতীয়পর্বের ভোটগ্রহণ হবে।

এরদোগানের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ

২০০৩ সাল থেকে তুরস্কের ক্ষমতায় রয়েছেন এরদোয়ান। প্রথম তিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এরপর ২০১৪ সালের আগস্ট মাসে প্রেসিডেন্ট হন তিনি। তার নেতৃত্বে পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোরগুরুত্বপূর্ণ সদস্য, ওই অঞ্চলে বড়সামরিক শক্তি ও সেই সঙ্গে ক্রমশ বড় অর্থনৈতিক শক্তিওহয়ে ওঠার পথে তুরস্ক।

২০১৮ সালে এরদোয়ান একটি নতুন শাসনব্যবস্থা চালু করেন। এই ব্যবস্থা দেশটির প্রেসিডেন্টের হাতে বেশির ভাগ ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে। আগে প্রেসিডেন্টের পদটি ছিল মূলত আনুষ্ঠানিক পদ। নতুন ব্যবস্থায় প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট নির্বাচন একই দিনে অনুষ্ঠানের নিয়ম করা হয়।

তুরস্কের অর্থনৈতিক মন্দা, নাগরিক অধিকার ও স্বাধীনতা সংকুচিত করার জন্য ৬৮ বছর বয়সী এরদোয়ানকে দায়ী করছে বিরোধীরা। তারা তার বিরুদ্ধে ‘এক ব্যক্তির শাসন’ব্যবস্থা চালুর অভিযোগও করছে।

তবে এবার তার সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছেবলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ছয় দলেরবিরোধী জোট এখনও প্রেসিডেন্টপদপ্রার্থীর নাম জানায়নি। তবে আগামী সপ্তাহেই তা ঘোষণা করা হবে বলে জানা গেছে। এছাড়া কুর্দিদের প্রতি সহানুভূতিশীল রাজনৈতিক দল জানিয়েছে, তারা আলাদা করে প্রার্থী দেবে।

লুজান চুক্তি কী, কী আছে তাতে

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে উসমানীয় সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। যুদ্ধশেষ হওয়ার পর সমাপ্তকারী চূড়ান্ত চুক্তি হিসেবে সুইজারল্যান্ডের লুজান শহরে এই চুক্তিসই হয়েছিল। চুক্তিতে একদিকে ছিলেন উসমানীয় সাম্রাজ্যের উত্তরসূরি তুরস্কের প্রতিনিধিরা।

অন্যদিকেব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালি, জাপান, গ্রিস, রোমানিয়া এবং যুগোস্লাভিয়ার প্রতিনিধিরাছিলেন। সাত মাস ধরেআলোচনার পর ১৯২৩ সালের২৪ জুলাই চুক্তিটিতে সই হয়।

চলতি ২০২৩ সালের ২৪ জুলাই সেইচুক্তির মেয়াদ শেষ হবে। ওইদিন পশ্চিমাদের সব শর্তের শিকলছিঁড়ে যাবে। গত সেই শিকল ছেঁড়ার মুক্তি ইতোমধ্যে উদ্‌যাপনশুরু করেছে তুরস্ক।

দেশটির নেতাদের বিশ্বাস, লুজান চুক্তিরনাগপাশ থেকে মুক্তির পরতুর্কিরা ফের উসমানীয় সাম্রাজ্যফিরিয়ে আনতে পারবে না। কিন্তু তুরস্ক এমন এক পরাশক্তিহিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারবে, যা হারানো গৌরবের কথা গোটা দুনিয়াকে মনে করিয়ে দেবে।

সর্বশেষ খবর