Homeসর্বশেষ সংবাদরাজধানীর সড়কগুলো যেন মৃত্যুফাঁদ, প্রাণহানি-পঙ্গুত্বের মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে

রাজধানীর সড়কগুলো যেন মৃত্যুফাঁদ, প্রাণহানি-পঙ্গুত্বের মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে

একের পর এক সড়ক দুর্ঘটনা আর প্রাণহানির ঘটনায় রাজধানী ঢাকা দিনে দিনে মৃত্যুফাঁদে পরিণত হলেও সমস্যা সমাধানের চেয়ে জিইয়ে রাখতেই যেন বেশি স্বাচ্ছদ্য কর্তৃপক্ষের। কেননা প্রায় প্রতিটি দুর্ঘটনার পরেই দায়ভার চাপে চালক, পথচারী কিংবা যানবাহনের ঘাড়ে। অথচ বছরের পর বছর ভাঙাচোড়া রাস্তা, প্রয়োজনীয় সংকেত কিংবা স্ট্রিট লাইট না থাকাসহ আরও অনেক কারণে সড়ক মৃত্যুকূপ বানিয়ে রেখেও পার পেয়ে যান দায়িত্বশীলরা।

দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির জন্য এমন উদাসীনতাও বড় কারণ উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু চালক নন, কাঠগড়ায় দাঁড় করানো উচিত দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষকেও। যদিও কর্তৃপক্ষের স্বভাবসুলভ ব্যাখা, মেরামতে নেয়া হবে ব্যবস্থা।

২০২০ সালের ৪ নভেম্বর। রাজধানীর বাড্ডা থেকে উত্তরার অফিসে যাওয়ার কথা ছিল বেসরকারি চাকরিজীবী সাজ্জাদুল বারির। কিন্তু সেদিন তার অফিস যাওয়া হয়নি। কুড়িল ফ্লাইওভার থেকে নামতে গিয়ে ছোট্ট এক গর্তে পড়ে মোটরসাইকেলের চাকা। ছিটকে পড়েন তিনি। পেছন থেকে দ্রুত গতিতে ছুটে আসা বাসের চাকা পিষে দেয় সাজ্জাদের মাথা।

সজ্জাদের অকাল মৃত্যুর পর পেরিয়েছে চারটি বছর। এরই মধ্যে তালিকায় যুক্ত হয়েছেন আরও অনেকে; আরও অনেক যানবাহন। কিন্তু কতটুকু বদলেছে পথের চিত্র?

অনিয়ম আর উদাসীনতার গল্পের শুরুটা হোক ছোট কিছু দিয়েই। স্বাভাবিক দৃষ্টিতে সড়কগুলোতে ছোট ছোট গর্ত বড় কোনো সমস্যা মনে না হলেও এমন গর্ত বাইকারদের প্রাণ কেড়ে নেয়ার জন্য যথেষ্ট। সমগ্র রাজধানীজুড়ে পথের এমন বিষফোঁড়ার সংখ্যা গুণে শেষ করার নয়, যার প্রতিটিই এক একটি মৃত্যুফাঁদ।

মেহেদী হাসান নামের এক বাইকার সময় সংবাদকে বলেন, দিনের বেলায় ছোট ছোট গর্তগুলো দেখা যায়। কিন্তু রাতে এমন গর্তে দুর্ঘটনার শঙ্কা থেকে যায়। এছাড়া দিনেও অনেক সময় এসব গর্ত লক্ষ্য করা যায় না।

ভাঙাচোড়া রাস্তার প্রতিযোগিতা হলে গ্রামীণ জনপদকেও হয়তো হার মানাবে রাজধানীর বুকে গেন্ডারিয়ার একটি সড়ক। এই সড়কটির বেহাল অবস্থা দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে। প্রধান সড়কের বাইরে অনেক অলিগলির অবস্থাও খুব একটা সুখকর নয়। কোথাও সড়কের চেয়ে উচু ম্যানহোল। আবার কোথায় দিনের পর দিন পড়ে আছে উন্মুক্ত অবস্থায়। হাতছানি দিচ্ছে বড় কোনো অঘটন-দুর্ঘটনার।

ভাঙাচোড়া কিংবা খানাখন্দ বাদ দিলে রাজধানীর অন্যান্য সড়ক দেখতে মন্দ নয়। বেশ চকচকে, পিচঢালা। তবে একটু ভালো করে মনোযোগ দিলে এসবে উঠে আসে একের পর এক অসঙ্গতি। কোথাও নেই ঠিকঠাক লেন মাকিং, স্পিডব্রেকারের মার্কিংতো দূরের কথা মাপজোখের যেন নেই তালের ঠিক আর জেব্রা ক্রসিংতো রাজধানীবাসী ভুলতেই বসেছে। রোড ডিভাইডারগুলোও চালকের পক্ষে বুঝে ওঠা দায়। নেই তেমন কোনো সংকেত। একই অবস্থা ফ্লাইওভারে ওঠার পথও। সব মিলিয়ে পুরো পথই যেন এক হ য ব র ল অবস্থা।

গত ১৩ মার্চ, রাত আনুমানিক ১টা। সব চেয়ে পরিকল্পিত-গোছানো হাতিরঝিল ব্যবহার করে মোটরসাইকেল যোগে রামপুরা থেকে বাংলামোটরের বাসায় যাচ্ছিলেন গণমাধ্যমকর্মী বিপ্লব। তবে সেই রাতে তার বাসায় ফেরা হয়নি অচেতন অবস্থায় যেতে হয় হাসপাতালে। দুর্ঘটনায় প্রাণে বেঁচে গেলেও মারাত্মক আহত হন তিনি। বিপ্লবের দাবি, স্বাভাবিক গতির মোটরসাইকেল কিছু বুঝে ওঠার আগেই হয়ে যায় নিয়ন্ত্রণহীন।

আলো ঝলমলে রাতের দৃষ্টিনন্দন হাতিরঝিল। দূর থেকে অন্তত এটিই মনে হয়। তবে সড়কের দিকে নজর দিলে ধরা পড়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন ভুতুড়ে এক পরিবেশ। অধিকাংশ সড়ক বাতিই অচল-অকার্যকর। অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশে ঠিকঠাক দেখার উপায় নেই স্পিডব্রেকার কিংবা রোড ডিভাইডার। জরুরি সংকেতগুলোতেও মানা হয়নি সঠিক নিয়ম। ফলাফল দুর্ঘটনা মৃত্যু আর পঙ্গুত্বের সংখ্যা বৃদ্ধি ছাড়া কিছুই নয়।

রাজধানীজুড়ে সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যানও ইঙ্গিত দিচ্ছে ভয়াবহতার। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদন বলছে, ২০২২ সালে তার আগের বছরের তুলনায় ঢাকায় দুর্ঘটনা বেড়েছে প্রায় ৯৮ শতাংশ। অন্যদিকে প্রাণহানি বেড়েছে ৮০ শতাংশ, যার বেশিরভাগই ঘটেছে রাত এবং ভোরে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সহকারী পুলিশ কমিশনার মোস্তাফিজুর রহমান সময় সংবাদকে বলেন,
নিরাপদ সড়ক তো আসলে নেই! ভাঙাচোরা থাকে। প্রয়োজনীয় রোড সাইন থাকে না। এটা ইমিডিয়েট ঠিক হচ্ছে না, কিন্তু গাড়ি ইমিডিয়েটলি চলছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ বলেন, ‘বড় আকার ধারণ না করলে, তারা কখনোই ব্যবস্থা নেয় না। কিন্তু এর মধ্যেই অনেক দুর্ঘটনা ঘটে, প্রাণহানিও হয়।’

‘আমাদের রাস্তাগুলো স্মুথ রাখতে হবে। এর জন্য প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। রিকশাগুলো রাস্তা থেকে সরিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করতে হবে’, যোগ করেন এই অধ্যাপক।

সিটি করপোরেশন, সড়ক ও জনপদ বিভাগ ও রাজউকসহ তিনটি সংস্থা রাজধানীর সড়ক সংস্কার ও মেরামতের দায়িত্বে থাকলেও নিয়মিত দেখভালের বিষয়টি মেনে চলে না কোনো সংস্থাই। এর ওপর আছে বিভিন্ন সেবা সংস্থার বছরজুড়ে খোঁড়াখুঁড়ি।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘একটি খানাখন্দও মেরামত ছাড়া থাকুক, সেটি আমরা চাই না। ঠিকাদার নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে ব্যর্থ হলে আমরা তাদের ওপর অতিরিক্ত জরিমানা আদায় করি।’

সর্বশেষ খবর