মু.ওয়াহিদুর রহমান মুরাদ,করেসপন্ডেন্ট।।
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার রহমতখালী , রামগঞ্জ উপজেলার বীরেন্দ্র খাল , কমলনগর ও রামগতির জারিদোনা খাল, রায়পুর উপজেলার ডাকাতিয়া ও মেঘনা নদীর তীরবর্তী দুপাঁড় দিন দিন বেদখল হয়ে যাচ্ছে।
জেলার চন্দ্রগঞ্জ থেকে জেলা শহর পর্যন্ত রহমতখালীর বিভিন্ন পয়েন্টে খালের দু’পাড়ে গড়ে উঠেছে অবৈধ স্থাপনা।এতে দিন দিন সংকুচিত হয়ে এক সময়ের ঐতিহ্যবাহী রহমতখালী খাল এখন তার অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। এছাড়া বাজারকেন্দ্রীক ময়লা-অবর্জনা ফেলার কারণে দূষিত হচ্ছে খালের পানি।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সদর উপজেলার চন্দ্রগঞ্জ, মান্দারী, জকসিন বাজার এবং পৌর এলাকার ঝুমুর সিনেমাহল সংলগ্ন, মাদাম, বাজার ব্রিজ সংলগ্ন খালের দু’পাড়ে, গোশত হাটা সংলগ্ন মসজিদের পাশে রহমতখালীর পাড়ে স্থায়ী এবং অস্থায়ী ইমারত বা দোকান ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। এ কয়েকটি স্থানে পুরনো স্থাপনার পাশাপাশি নতুন করে স্থাপনা তৈরি হচ্ছে।প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাধাপ্রাপ্ত না হওয়ায় দখলদাররা দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে ঝুমুর সিনেমাহল সংলগ্ন ময়দার মেলের পেছনের বিস্তীর্ণ অংশ ও বাজার ব্রিজের পূর্ব পাশে হায়দার শপিং কমপ্লেক্সের পেছনে খালের দু’পাড় দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে। আর মান্দারী বাজারের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া রহমত খালী সরু নালায় পরিণত হওয়ার উপক্রম হয়েছে ।আর শহরের বাইরে জকসিন, মান্দারী, চন্দ্রগঞ্জ অংশের তালিকা তৈরি করা হয়নি। এছাড়া রামগঞ্জের বীরেন্দ্র খালের ৯৬ জন অবৈধ দখলদারের তালিকা প্রণয়ন করেছে উপজেলা প্রশাসন।
লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলাব্যাপী পানি নিস্কাশন ও সেচ প্রকল্পের ব্যবহৃত বিরেন্দ্র খালটি লক্ষীপুর জেলা পরিষদ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিকে উদাসীনতা একদিকে দখলদারদের দখলদারিত্ব অন্যদিকে ব্যবসায়ীদের দায়িত্বহীনতা ময়লা আবর্জনার ভাগাড়ে চরম অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। ২শত বছরের পুরোনো খালটি হাজীগঞ্জ থেকে রামগঞ্জ পৌর শহর হয়ে নোয়াখালী জেলা পর্যন্ত বিস্তৃত। রামগঞ্জ ও সোনাপুর বাজারের ব্যবসায়ী,স্থানীয় বসবাসকারীরা ডাস্টবিন হিসেবে প্রতিনিয়তই ময়লা আবর্জনা ফেলছেন খালটিতে।এতে খালটির পুরো অংশ জুড়ে ময়লা আবর্জনা, কচুরিপানা, কচুগাছ জন্মানোসহ দীর্ঘদিন সংস্কার না করায় সেগুলো পঁচে প্রচন্ড দূর্গন্ধের সৃষ্টি হচ্ছে। এতে খালের আশেপাশে বসবাসকারীদের মারাত্বক দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। দীর্ঘদিন খাল পরিষ্কার না করায় মশার উপদ্রব ভয়ঙ্কর আকার ধারন করেছে।রামগঞ্জ মধ্য বাজার ব্রিজ থেকে মডেল মসজিদ পর্যন্ত ৬৫ নম্বর আঙ্গরপাড়া ও ৬৭ নম্বর কাজিরখিল মৌজার অংশে খালের ওপর দখলদাররা অবৈধভাবে স্থাপনা তৈরি করে রেখেছে।
প্রভাবশালীদের দখল ও দূষণের প্রভাবে রামগতি কমলনগরের জারিদোনা খালসহ জেলার ৭৬টি খাল এখন সংকীর্ণ ও পানি শূন্য হয়ে পড়েছে। অবাধে খাল দখল করে দোকান পাট, বাড়ি ঘর নির্মাণ, ময়লা আবর্জনা ফেলে পানির প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করার কারণে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এতে করে নৌযান চলাচল হচ্ছে না যেমনি তেমনি কৃষিকাজ ব্যাহত হচ্ছে এ অঞ্চলে। জলাবদ্ধতা সৃষ্টি, দেশীয় মাছ ধরাসহ নানা সুবিধা বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন এ অঞ্চলের লাখো মানুষ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সর্বশেষ ১৯৪৭-৪৮ সালে ২শত বছরের পুরনো বিরেন্দ্র খালটি সংস্কার করা হলেও পরবর্তীতে আর সংস্কার করার উদ্যোগ নেয়নি কেউ। লক্ষ্মীপুর রহমতখালি খালের সংযোগ থেকে শুরু হয়ে বিরেন্দ্র খালটি দু’টি শাখায় বিভক্ত হয়। এর একটি শাখা রামগঞ্জ হাজীগঞ্জ হয়ে চাঁদপুর মেঘনা নদীতে মিলিত হয়েছে। অপর শাখা রামগঞ্জ থেকে নোয়াখালী সোনাইমুড়ি হয়ে নদীতে প্রবাহিত হয়েছে। খালের অধিকাংশই রামগঞ্জ পৌরসভার বাজার ও আবাসিক এলাকার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে। বিরেন্দ্র খালটির লক্ষ্মীপুর জেলা পরিষদ ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীন। তবে খালটি নিয়ে উভয় বিভাগের মধ্যে জটিলতাও রয়েছে।
স্থানীয় মুরুব্বি আক্কাস আলীর সাথে কথা বললে তিনি আক্ষেপের সাথে জানান, দখল আর দূষণের কবলে পড়ে বিরেন্দ্র খালটি তার যৌবন হারিয়েছে। অথচ নব্বইরদশকেও রাজধানীর সাথে রামগঞ্জ উপজেলার বাণিজ্যিক যোগাযোগের সহজ মাধ্যম ছিল এই বিরেন্দ্র খালটি। দুইশত বছরের পুরানো এ খাল দিয়ে মেঘনা নদী হয়ে ছোট-বড় ট্রলারে পণ্যসামগ্রী আনা-নেয়া করতো ব্যবসায়ীরা। রামগঞ্জ থানার সামনের ঘাটে ভিড়তো ট্রলারগুলো। এ খালটি দিয়ে কলাবাগান, মৌলভীবাজার ও সোনাপুর উত্তর বাজার এলাকায় সরকারিভাবে নির্মিত ঘাটে চাঁদপুর থেকে ট্রলারে করে আনা মালামাল নামানো হতো।
কৃষক রমযান আলী বলেন , প্রবাহমান পানি এখানকার কৃষি জমির সেচের কাজে ব্যবহার হতো। কিন্তু পরবর্তী সময় অবৈধ দখলদারদের দখলে চলে যাওয়ায় ঐতিহ্যবাহী খালটি এখন অস্তিত্ব সঙ্কটে রয়েছে। এমনকি দুইটি ঘাট দখল হয়ে গেলেও সর্বশেষ স্মৃতি হিসেবে থাকা কলাবাগান এলাকার ঘাটটিতেও ময়লা ফেলে দখলের চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
এদিকে সংস্কারের অভাবে বিভিন্ন হাট-বাজার ও আবাসিক এলাকার পতিত আবর্জনায় বন্ধ হয়ে আছে খালটির প্রবাহমানস্রোতধারা। এসব আবর্জনা পঁচে নষ্ট হয়ে গেছে পানি, ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ ও রোগবালাই। এতে চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।অন্যদিকে, রামগঞ্জ পৌর এলাকাসহ বিভিন্ন হাট-বাজার ও আবাসিক এলাকায় ড্রেনেজ ও ডাস্টবিন ব্যবস্থা না থাকায় ওইসব স্থানের ময়লা-আবর্জনা ফেলা হচ্ছে খালে। এতে খালে পানির রাতে বন্ধ হয়ে ও আবর্জনা পচে ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ, বেড়েছে মশার উপদ্রব। সৃষ্টি হচ্ছে ডেঙ্গুসহ বিভিন্ন রোগ। হুমকিতে রয়েছে পরিবেশ। সংস্কার আর খননের অভাবে বর্ষাকালেও আগের মতো পানি আসেনা এক সময়ের খরস্রোত এ খালে।এদিকে খালটি পুনরুদ্ধারের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্টদের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন স্থানীয়রা।
লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের আদেশে রামগঞ্জ উপজেলা ভুমি অফিস তৈরী করা সরেজমিন তদন্ত প্রতিবেদনের আলোকে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয় থেকে ২০২১ সালের ২১ মার্চ উচ্ছেদ তালিকা পাঠালেও তা রহস্যজনক ভাবে বাস্তবায়ন হয়নি
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) উম্মে হাবীবা মীরা জানান, বিরেন্দ্র খালটি অবৈধ উচ্ছেদ করতে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও উপজেলা কৃষি অফিসের সমন্বয়ে,সহকারী কমিশনার (ভুমি) অবৈধ তালিকা তৈরী এবং সীমানা চিহিৃত করে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে প্রতিবেদন প্রেরন করা হয়। তবে বিরেন্দ্র খালটি অবৈধ দখলমুক্ত করা জরুরী হয়ে পড়েছে।
জানা যায়, লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার জারির দোনা খালের আশির দশকেও বড় বড় নৌকা ও বিভিন্ন পন্য আনা নেওয়া হতো এ খাল দিয়ে। খালটি কমলনগরের চর কাদিরা ইউনিয়নের ভলুয়া নদী থেকে শুরু হয়ে হাজির হাট, ফলকন, রামগতির চর বাদাম হয়ে মেঘনায় মিলিত হয়। যার গড় প্রস্থ ছিল ৩৪ ফুট। বর্তমানে খালের চিহ্ন ও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
কমলনগরের হাজির হাট এলাকায় স্থানীয় প্রভাবশালীরা অবৈধভাবে খাল দখল করে দোকান পাট, ঘর বাড়ী নির্মাণ করে আছেন। আশে পাশে দখল ও দূষনের ফলে নালা ও নর্দমায় পরিণত হয়েছে খালটি। এ খালটির মতো জেলার আরো ৭৬টি খালের বেশীর ভাগ খালের বর্তমানে এমনই অবস্থা। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে দখলদাররা অবাধে দখল উৎসবে মেতে উঠেছেন
বলে অভিযোগ করেন এলাকাবাসী।
একইভাবে জেলার কমলনগরের মুছার খাল, যেটির তোরাবগঞ্জ অংশে দখল হয়ে গেছে, একই উপজেলার তুলা তুলি খালের পূর্ব চর লরেন্স বাজারে দখল হয়ে গেছে। একইভাবে সদরের গরুর খাল, ভবানীগঞ্জ খাল, জিয়ার খাল, রামগতির কাটার খাল, রামগঞ্জের বেড়ীর খালসহ সবকয়টি খালই দখল দুষণে অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছে এখন। ফলে খালগুলোর পানি ব্যবহার, কৃষি কাজে পানি না পাওয়ায় উৎপাদন ব্যাহত হওয়া, দেশীয় মাছ ধরতে না পারা ও নৌ চলাচল বন্ধসহ বর্ষাকালে জলাবদ্ধতায় এ অঞ্চলের বাসিন্দারা সুবিধা বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন।
খাল দখলমুক্ত নিয়ে কাজ চলছে , উপজেলা প্রশাসন যেকোন সময় খাল দুষণমুক্তকরনে কাজ করবে। খালগুলো দখল ও দুষণমুক্ত না হলে কৃষিতে ব্যাপক ধস নামতে পারে এমনটা জানান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সূচিত্র দাস।তিনি বলেন, জারির দোনা খাল ও উপজেলার বিভিন্ন এলাকার খালগুলো দখল ও দুষণমুক্ত করতে জেলা মিটিং প্রদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। খুব শীগ্রই পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিসে কথা বলা হচ্ছে। কিভাবে খালগুলো দখল ও দুষণমুক্ত করা যায়।
আন্যদিকে ডাকাতিয়া নদী দুপাঁড় দখল করে রায়পুর থেকে চরবংশী পর্যন্ত দখল করে অর্ধশত অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠেছে। এতে দীর্ঘ খাল সরু হয়ে পানি প্রবাহ কমে যাচ্ছে। ফসলি জমিতে সেচ ও পানি নিষ্কাশনে বিঘ্ন ঘটার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন অভিযোগের প্রেক্ষিতে রায়পুর খাসেরহাটের চমকাবাজার, মোল্লারহাট ও বটতলা নামক স্থানে অবৈধভাবে বেড়িবাঁধের পাশে চার ব্যবসায়ীর ইমারত নির্মাণ ভেঙে দেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট অঞ্জন দাশ ।তবুও থেমে নেই নদী দখল।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি জাতীয় নদ-নদী রক্ষা কমিশন কর্তৃক প্রদত্ত নির্দেশনায় অবৈধ দখলদারদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তালিকায় রহমতখালী খালের শুধুমাত্র জেলা শহরের মাদাম থেকে বাজার ব্রিজ অংশ পর্যন্ত ৭৬ নম্বর মজুপুর মৌজার ২১৩ দাগ, ৬৩ বাঞ্চানগর মৌজার ৮৪০১ ও ১৬৬২২ দাগে মাত্র ৬জন দখলদারদের নাম রয়েছে। শুধু শহর অংশেই অনেক দখলদার তালিকার বাইরে রয়ে গেছে। স্থানীয়রা খালের দু’পাড়ে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের দাবি জানালেও অজ্ঞাত কারণে পাউবো সেগুলো অপসারণ করেনি। উল্টো দিন দিন নতুন স্থাপনা তৈরি হতে দেখা গেছে।
লক্ষ্মীপুর পৌর মেয়র মোজ্জামেল হায়দার মাসুম ভূঁইয়া বলেন, গত বর্ষায় লক্ষ্মীপুর পৌরসভার জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল পরিষ্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ময়লা পরিষ্কার করলেও খাল দখলের কারণে আবার ময়লা জমে যায়। জেলা প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে অভিযান চালিয়ে রহমতখালী খালের পৌরসভা অংশে অবৈধ দখল মুক্ত করা হবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ফারুক আহমেদ বলেন,রায়পুর উপজেলার ডাকাতিয়া নদী দখল, রামগঞ্জের বীরেন্দ্র খাল এবং সদর উপজেলার রহমতখালী খালের শুধুমাত্র বাজার অংশে অবৈধ দখলদারদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষে ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার এবং আমাদের সার্ভেয়ার কর্তৃক যৌথভাবে জরিপ ও তদন্তের মাধ্যমে তালিকা তৈরি করেছে।জেলা-উপজেলা প্রশাসন এবং পৌর কর্তৃপক্ষের সমন্বয়ে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হবে। খালের যে সব স্থানে অবৈধ দখলদারদের তালিকা তৈরি করা হয়নি, সেগুলো সরেজমিনে দেখে তালিকা করা হবে। তিনি বলেন, ২০১৯ সালে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু করোনার কারণে সেটা থমকে ছিল। কিন্তু এবার খালের দু’পাড়ে সৌন্দর্যবর্ধন করে জনসাধারণের হাঁটার রাস্তা তৈরির পরিকল্পনা করা হয়েছে। তাই প্রশাসনের পক্ষ থেকে উচ্ছেদের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।