ফরিদপুরের ভাঙা থেকে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া পর্যন্ত পদ্মা সেতু হয়ে পরীক্ষামূলক ট্রেন চলাচল কার্যক্রম উদ্বোধন করেছেন রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন।
মঙ্গলবার (৪ এপ্রিল) দুপুর সোয়া ১টায় পদ্মা বহুমুখী সেতুতে শুরু হয় পরীক্ষামূলক এ ট্রেন চলাচল। এতে যাত্রী হয়ে রেলপথ মন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন নির্মিত রেলপথসহ প্রকল্পের সার্বিক কাজ পরিদর্শন করেন।
আগেই পদ্মা সেতুর ভাঙ্গা থেকে মাওয়া স্টেশন পর্যন্ত ৪২ কিলোমিটার রেলপথ প্রস্তুত করা হয়। বিশেষ ট্রেনটি চলাচল করবে এ ৪২ কিলোমিটার রেলপথেই। পদ্মা সেতু ঘিরে দেশের আধুনিক রেল নেটওয়ার্কের খবরে আনন্দে উচ্ছ্বসিত পদ্মা পাড়ের মানুষ।
পদ্মা সেতুর রেলসংযোগ প্রকল্পের মাওয়া-ভাঙ্গা অংশের প্রকল্প ব্যবস্থাপক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাঈদ আহমেদ জানান, ‘গ্যাং কার দিয়ে ভাঙ্গা থেকে মাওয়া পর্যন্ত ৪২ কিলোমিটার রেলপথ পরীক্ষা করে দেখা হবে। এ পথে ১২০ কিলোমিটার গতি থাকলেও টেস্ট-রান করা হবে ৩০-৪০ কিলোমিটার বেগে।
পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক আফজাল হোসেন জানান, পরীক্ষামূলকভাবে গ্যাং কার ট্রেনটি ভাঙ্গা থেকে রওনা হয়ে পদ্মা সেতু পাড়ি দিয়ে মাওয়া আসবে। এটি মূলত নির্মিত রেলপথ ইন্সপেকশনের কাজে ব্যবহার করা হয়।
আফজাল হোসেন আরও জানান, আগামী সেপ্টেম্বরে ঢাকা থেকে পদ্মাসেতু হয়ে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল শুরু হতে পারে। অন্যদিকে প্রকল্পের মেয়াদ অনুযায়ী ২০২৪ সালের জুনে ঢাকা থেকে ভাঙ্গা হয়ে যশোর পর্যন্ত পুরো রেলপথটি চালুর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ২০৩০ সাল নাগাদ রেলপথটির ঢাকা-ভাঙ্গা অংশে প্রতিদিন ১৩ জোড়া ট্রেন চলবে। একইভাবে ভাঙ্গা-কাশিয়ানী অংশে প্রতিদিন সাত জোড়া এবং কাশিয়ানী-যশোর অংশে প্রতিদিন পাঁচ জোড়া ট্রেন চলবে।
তিনি আরও বলেন, এ সময়ের মধ্যে ঢাকা-ভাঙ্গা অংশে বছরে ৪০ লাখ, ভাঙ্গা-কাশিয়ানী অংশে বছরে ১৭ লাখ ও কাশিয়ানী-যশোর অংশে বছরে সাড়ে ১৩ লাখ যাত্রী পরিবহন করা হবে। ‘ওয়ান-ডিরেকশন’ বা একমুখী চলাচলের ওপর ভিত্তি করে প্রাক্কলনটি তৈরি করেছে চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (সিআরইসি)।
গত বুধবার (২৯ মার্চ) সেতুর ২৫ নম্বর খুঁটির কাছে বাকি থাকা ৭ মিটার রেলপথ নির্মাণ শেষ হওয়ার ৭২ ঘণ্টা পরও রেল ট্র্যাক মহড়া হিসেবে সেতুতে চলাচল করেছে বলে দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানিয়েছে।
প্রকল্প কর্মকর্তারা আরও জানান, যশোর থেকে ঢাকা পর্যন্ত ১৭২ কিলোমিটার দীর্ঘ লেভেল ক্রসিংবিহীন রেল সংযোগ প্রকল্পের বড় চ্যালেঞ্জ ছিল পদ্মা সেতুতে পাথরবিহীন রেলপথ নির্মাণ। আর সেটি সুচারুরূপে সম্পন্ন হওয়ায় দেশের আধুনিক রেল নেটওয়ার্কে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে।
ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশ রেলওয়ে ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি ৭৯ লাখ টাকায় যশোরের সঙ্গে রাজধানীর সংযোগ স্থাপনের প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এ প্রকল্পে চীনের এক্সিম ব্যাংক ২১ হাজার ৩৬ কোটি ৭০ লাখ টাকা ঋণ দিচ্ছে। চীন সরকার মনোনীত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেড চায়না জিটুজি সিস্টেমের আওতায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।
প্রকল্পটি সম্পন্ন করার পর রেল যোগাযোগ ব্যবস্থায় দেশের মধ্য ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানী ঢাকা এবং পদ্মা সেতুর মাধ্যমে মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও নড়াইল জেলার নতুন এলাকাজুড়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হবে। প্রকল্পটির মাধ্যমে ঢাকা-যশোর-খুলনার মধ্যে ২১২.০৫ কিলোমিটার সংক্ষিপ্ত রুট এবং উন্নত পরিচালন সুবিধার বিকল্প রেলপথ সংযোগ স্থাপিত হবে।
এটি বাংলাদেশে ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আরেকটি সাব-রুট স্থাপন এবং জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক মালবাহী ও বিজি কনটেইনার ট্রেন পরিষেবা চালু করবে। এ রুটে কনটেইনার পরিবহনের ক্ষেত্রে গতি ও লোড সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত হবে।
সরকার ২০১৬ সালের মার্চ মাসে ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের অনুমোদন দেয়। পদ্মা সেতুতে যানবাহন চলাচল শুরু হয়েছে নয় মাস আগে। এবার ট্রেন চলাচলের জন্যও প্রস্তুত দেশের দীর্ঘতম এ সেতু।
প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, পদ্মা সেতু রেল লিংক প্রকল্পের কাজ তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে – ঢাকা থেকে মাওয়া, মাওয়া থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা ও ভাঙ্গা থেকে যশোর।
অগ্রগতির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৩০ মার্চ পর্যন্ত ঢাকা থেকে মাওয়া ৭৪.১৪ শতাংশ, মাওয়া থেকে ভাঙ্গা অংশে ৯২.৮৯ শতাংশ ও ভাঙ্গা থেকে যশোর পর্যন্ত ৬৮.৪৫ শতাংশ কাজ হয়েছে। পুরো ঢাকা-যশোরের এ প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি হয়েছে ৭৫.৯২ শতাংশ।
যাত্রীদের ট্রেনে চলাচলের জন্য ভাঙ্গা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে মাওয়া পর্যন্ত চারটি স্টেশন ও একটি জংশন স্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে। ভাঙ্গা স্টেশন নির্মাণের অগ্রগতি ৭০ শতাংশ, ভাঙ্গা জংশন স্টেশনের অগ্রগতি ৫৬.৩৩ শতাংশ, শিবচর জংশন স্টেশনের অগ্রগতি ৭৪.৫০ শতাংশ, পদ্মা স্টেশনের অগ্রগতি ৮৭.৭৫ শতাংশ ও মাওয়া স্টেশনের কাজের অগ্রগতি হয়েছে ৮৯ শতাংশ।