শেরপুর (বগুড়া) প্রতিনিধি।।
বগুড়ার শেরপুর উপজেলায় সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের কর্মকর্তা কর্মচারী ও দলিল লেখক সমিতির কাছে জিম্মি এলাকার সাধারণ মানুষ। জমির ক্রেতা বিক্রেতাদের কাছ থেকে প্রতিদিন হাতিয়ে নেওয় হচ্ছে লক্ষ লক্ষ টাকা। এছাড়াও ভুয়া ওয়ারীশন সদন, নকল খতিয়ান ও ভূমিউন্নয়ন কর পরিশোধের রশিদের মাধ্যমেও করা হচ্ছে দলিল নিবন্ধন। এই অনিয়ম ও দুর্নীতির নিয়ে স্থানীয় প্রশাসনের নিরবতায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ভুক্তভোগীরা।
সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের তথ্য অনুযায়ি একটি বিক্রয় দলিলের জন্য লিখিত মোট মূল্যের রেজিস্ট্রেশন ফি ১%, স্ট্যাম্প শুল্ক ১.৫%, স্থানীয় সরকার কর ইউনিয়নের জন্য ২% ও পৌরসভার জন্য ৩% ও উৎসে আয়কর ৪% হারে এবং দশ পাতার একটি দলিলের জন্য হলফ নামা ৩শ টাকা, ই ফিস ১শ টাকা, এন ফিস ২৪০ টাকা, এনএন ফিস ৩৬০ টাকা কোর্ট ফি ১০ টাকা লাগার কথা। অর্থাৎ পৌর শহরে এক লক্ষ টাকা মূল্যের দলিল নিবন্ধন করার জন্য সর্ব সাকুল্যে সরকারি খরচ ১০ হাজার ৫১০ টাকা ও ইউনিয়নের ক্ষেত্রে তা ৮ হাজার ৫১০ টাকা। কিন্তু সাব-রেজিস্টার ও দলিল লেখক সমিতির কারসাজিতে একটি ১ লক্ষ টাকা মূল্যের দলিল নিবন্ধনের জন্য ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা গুনতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
দলিল নিবন্ধনের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সঠিক থাকলেও সমিতিই এখানে শেষ কথা। আর কোন কিছুর ঘটাতি থাকলে বা জাল কাগজ ব্যবহার করার করা হলে দিতে হয় বাড়তি টাকা। এসব স্বীকার করেছন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন দলিল লেখক।
তিনি বলেন, সমতির মোট সদস্য ১৯৬ জন। আর নেতা ৩২ জন। দলিল লিখে প্রথমে সমিতি ঘরে নিতে হয়। সেখানে দলিল মূল্যের প্রতি লাখে ১ হাজার টাকা জমা দিলে পাওয়া যায় যেকোন একজন নেতার স্বাক্ষর। এরপর সেটি সাব- রেজিস্টারের কাছে নিয়ে যেতে হয়। এর ব্যতয় ঘটলে ওই দলিল লেখকের সমিতির সদস্যপদ বাতিল করা হয়। সমিতির টাকা প্রতি সপ্তাহে বিভিন্ন হারে সদস্যদের মধ্যে বন্টন করা হয়।
তিনি আরও বলেন, দলিল লিখে সাব- রেজিস্টারের অফিসে নিলে ঘাটে ঘাটে টাকা দিতে হয়। দলিল মূল্যের প্রতি লাখে ৩০০, ডিআর ফি ৭০০ এবং বিক্রেতার টিপসহি ও দলিলের রশিদ জন্য ১০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়।
দলিলের নকল উত্তোলনের জন্য অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার অভিযোগ করেছেন শেরপুর পৌরশহরের উত্তর সাহাপাড়া এলাকার বাসিন্দা বিশ্বনাথ চন্দ্র দাস। তিনি বলেন, গত ৫ মার্চ আমি দুইটি দলিলের নকল উত্তোলন করেছি। এর জন্য আমার কাছ থেকে ৬ হাজার টাকা নেওয়া হয়েছে।
ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধের জাল রশিদের মাধ্যমে দলিল নিবন্ধনের তথ্যও পাওয়া গেছে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, শেরপুর সাব- রেজিস্ট্রি অফিসে গত ফেব্রুয়ারী মাসের ২৭ তারিখে একটি দলিল নিবন্ধন করা হয়েছে, যার নম্বর ১৩০২। দলিলের তথ্য অনুযায়ি উপজেলার খামারকান্দি ইউনিয়নের ঘোরদৌড় মৌজার জমির খতিয়ান নম্বর ৪১৩। এ ক্ষেত্রে ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধের যে রশিদটি ব্যবহার করা হয়েছে তা জাল বলে নিশ্চিত করেছেন খামারকান্দি ইউনিয়ন ভূমি উপ-সহকারী কর্মকর্তা শামীমুজ্জামান।
তিনি বলেন, “আমাদের সার্ভারের তথ্য অনুযায়ি ওই খতিয়ানের ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করা হয়নি। তাছাড়া কর পরিশোধের কিউআর কোড স্ক্যান করেও কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। তাই নিশ্চত করে বলা যায় রশিদটি জাল।“
আরও পড়ুন
জাল ওয়ারিশন সনদের মাধ্যমে নিজের জমি অন্য জনের নামে নিবন্ধন করার অভিযোগ করেছেন উপজেলার বিশালপুর ইউনিয়নের নাইয়ের পাড়া গ্রামের অমূল্য চন্দ্র সরকার (৭৬)। তার মৃত পিতাকে নিঃসন্তান দেখিয়ে একটি জাল ওয়ারিশান সনদ তৈরি করেন তার কাকাতো ভাই নির্মল চন্দ্র সরকার। এর পর তিনি ২০২২ সালের ১০ নভেম্বর সকল জমি তার দুই ছেলে মনোরঞ্জন চন্দ্র সরকার ও সুভাস চন্দ্র সরকারের নামে লিখে দেন। একই ওয়ারিশান সনদ দিয়ে জমিগুলোর নাম জারির আবেদন করা হলে জালিয়াতি ধরা পরে। বিশালপুর ভূমি অফিসের কর্মকর্তা নামজারির আবেদন নামঞ্জুর করার জন্য প্রতিবেদন দাখিল করেন। এই জালিয়াতির সত্যতা নিশ্চিত করেছেন বিশালপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাকির হোসেন।
এসব নিয়ে স্থানীয় প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ করেও প্রতিকার পাওয়া যায় না বলে দবি করেছেন শেরপুর পৌর শহরের বাসিন্দা নাজনীন পারভীন পলি।
তিনি বলেন, “গত ০৪ মার্চ আমি ২ শতাংশ জায়গা বিক্রি করতে গেলে দলিল লেখক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জামাল উদ্দিন সমিতির জন্য ১ লক্ষ ও অফিসের কর্মচারি জাহিদুল ইসলাম সাব-রেজিস্ট্রারের জন্য ২০ হাজার টাকা দাবি করেন। আমি টাকা দিতে রাজি হয়নি। তাই এখনও জমির দলিল নিবন্ধন করতে পারি নাই। এ নিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি ও সাংবাদ সম্মেলন করেছি। কিন্তু এখনও প্রতিকার পাইনি।“
তবে এসব অনিয়মের বিষয়ে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন শেরপুর সাব রেজিস্ট্রি অফিসের কর্মকর্তা মিজানুর রহমান। কথা বলার তার অফিসে একাধিক দিন যাওয়া হলেও সময় স্বল্পতার অযুহাতে কোন কথা বলতে রাজি হননি।
এ বিষয়ে বগুড়া জেলা রেজিস্ট্রার মো: রফিকুল ইসলাম বলেন, “আমার কাছে এখন পর্যন্ত কেউ কোন লিখিত অভিযোগ করেননি। তাই আমি বিশেষ কিছু বলতে পারব না। তবে অফিস চত্ত্বরে দলিল লেখক সমিতির ঘরের অনুমোদন নেই। স্থানীয় প্রশাসন চাইলে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারে।“