ফিলিস্থিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় গত প্রায় সাত মাস ধরে গণহত্যা চালাচ্ছে ইসরাইল। শুধু তাই নয়, গাজাবাসীর জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য ও পানীয় বন্ধ করে দিয়ে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। যা প্রতিদিনই কেড়ে নিচ্ছে অসংখ্য প্রাণ। ইসরাইলি এই দুষ্কর্মে অন্ধের মতো সহযোগিতা করছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও তার প্রশাসন।
ফাঁস হওয়া বেশ কিছু নথিতে গাজায় দুর্ভিক্ষ সৃষ্টিতে মার্কিন কর্তৃপক্ষের সহযোগিতার বিষয়টি উঠে এসেছে। নথি অনুযায়ী বাইডেনকে খোদ তার প্রশাসনের কর্মকর্তারাই ‘দুষ্কৃতিকারী’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।
দ্য ইন্ডিপেনডেন্টের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন বিষয়গুলো সামনে এনেছে। এতে বাইডেন প্রশাসনের অসংখ্য ভুল পদক্ষেপ ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত উন্মোচন করা হয়েছে যার ফলে উত্তর গাজায় বিপর্যয়কর দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে। ফাঁস হওয়া নথি, বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তাদের সাক্ষ্য এবং গাজার ভুক্তভোগীদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।
গত বছরের ৭ অক্টোবরে গাজা উপত্যকায় সামরিক আগ্রাসন শুরু করে ইসরাইল। এরপর গত সাত মাসেরও বেশি সময় ধরে সেই আগ্রাসন অব্যাহত রয়েছে। এতে এখন পর্যন্ত ৩৫ হাজারের বেশি নিরস্ত্র ও নিরীহ ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও প্রায় ৮০ হাজার। ধ্বংসস্তূপের নিচে চাঁপা পড়েছেন আরও ৭ সহস্রাধিক মানুষ।
ইসরাইলের নির্বিচার বোমাবর্ষণে গাজার ২৩ লাখ অধিবাসীর মধ্যে ১৯ লাখই এখন উদ্বাস্তু যারা গত কয়েক মাস ধরে খোলা আকাশের নিচে দিনাতিপাত করছেন। গাজার এসব বাসিন্দা বিদেশি সাহায্যনির্ভর হলেও সীমান্ত দিয়ে পর্যাপ্ত ত্রাণ সামগ্রী ঢুকতে না দেয়ায় শুরু থেকেই ব্যাপক খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয়। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে যা ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে রূপ নিয়েছে।
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো সেই প্রথম থেকেই দুর্ভিক্ষের ব্যাপারে সতর্কতা ও হুঁশিয়ারি দিয়ে আসছে। তবে গত সপ্তাহে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) প্রথমবারের মতো জানায়, ইসরাইলি আগ্রাসনের প্রায় সাত মাস পর উপত্যকাটির উত্তরাঞ্চলে ‘পুরোদমে দুর্ভিক্ষ’ শুরু হয়েছে।
গত ৫ মে মার্কিন সংবাদমাধ্যম এনবিসির সম্প্রচার করা এক সাক্ষাৎকারে ডব্লিউএফপির নির্বাহী পরিচালক সিন্ডি ম্যাককেইন বলেন, ইসরাইলি অবরোধের মধ্যে গাজার অধিবাসীরা দীর্ঘদিন ধরে বাইরের খাদ্য সহায়তার ওপর নির্ভরশীল ছিলেন।
এরই মধ্যে এ উপত্যকায় যুদ্ধ শুরু করার পর সেখানে মানবিক সহায়তা সরবরাহের ওপর ব্যাপকভাবে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে ইসরাইল। গাজার বাসিন্দাদের চূড়ান্তভাবে একঘরে করে ফেলেছে ও এখানকার একাংশকে দুর্ভিক্ষের মুখে ঠেলে দিয়েছে এটি। দুর্ভিক্ষ এখন ছড়িয়ে পড়ছে গাজার দক্ষিণে।
ত্রাণ সহায়তায় নিয়োজিত সংস্থাগুলো বলছে, আকাশ ও সমুদ্রপথে যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য দেশের সরবরাহ করা ত্রাণ গাজার ২৩ লাখ মানুষের জন্য যথেষ্ট নয়। তাদের ক্রমবর্ধমান একটি অংশ অপুষ্টির শিকার হওয়ার পর্যায়ে পৌঁছাচ্ছে। এছাড়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে শিশুদের বিকাশ এবং ক্ষুধায় মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটছে।
দ্য ইন্ডিপেনডেন্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিজেদের বিশেষজ্ঞ দল এবং ত্রাণ সহায়তা সংস্থা বারবার সতর্কবার্তা দেয়ার পরও পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। এর মাধ্যমে তিনি মূলত গাজায় দুর্ভিক্ষ সৃষ্টিতে ইসরাইলি কর্তৃপক্ষকে সহযোগিতা করেছেন বলে অভিযোগ উঠছে।
দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট জানিয়েছে, তারা মার্কিন ত্রাণ সংস্তা ইউএস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ইউএসএআইডি)-এর বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তা, মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের কর্মকর্তা ও গাজায় কর্মরত বিভিন্ন ত্রাণ সংস্থার কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছে। এছাড়া ইউএসএআইডির অভ্যন্তরীণ বহু নথি তাদের হাতে এসেছে।
প্রতিবেদন মতে, বর্তমান ও সাবেক মার্কিন কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকার ও ফাঁস হওয়া নথিগুলো বলছে যে, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও তার প্রশাসন দুর্ভিক্ষ ঠেকাতে গাজায় পর্যাপ্ত মানবিক সহায়তার অনুমতি দেয়ার জন্য মিত্র ইসরাইলকে রাজি করার জন্য নিজের সক্ষমতা ব্যবহার করার আবেদন বারবার প্রত্যাখ্যান করেছে বা উপেক্ষা করেছে।
সাবেক মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন যে, যুদ্ধবিরতি বা সংকট নিরসনের আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টাকে বাধা দিয়ে দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি তৈরি করতে ইসরাইলকে যাবতীয় কূটনৈতিক সহযোগিতা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র যার ফলে গাজায় ত্রাণ সহায়তা প্রবেশ ও সরবরাহ প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।
মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের সাবেক কর্মকর্তা জোশ পল, যিনি ইসরাইলি যুদ্ধে ঢালাও মার্কিন সমর্থনের কারণে পদত্যাগ করেছিলেন, তিনি দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্টকে বলেছেন,
একটা জনগোষ্ঠীকে অনাহারে মারার পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে। আর যুক্তরাষ্ট্র সেদিক থেকে শুধুমাত্র চোখই ফিরিয়ে থাকেনি, বরং দেশটি এর সঙ্গে সরাসরি জড়িত।
ইসরাইল বরাবর জোর গলায় বলে এসেছে যে, গাজায় কোনো ক্ষুধা বা খাদ্য সংকট নেই। উল্টো ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের ওপর দোষ চাপিয়ে বলেছে, গাজায় ত্রাণ সহায়তা কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করেছে হামাস।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, গত এপ্রিল পর্যন্ত গাজায় অপুষ্টি ও পানিশূন্যতার কারণে কমপক্ষে ৩২ জন মারা গেছে যার মধ্যে ২৮ জনই শিশু। মৃত্যুর প্রহর গুনছে আরও অনেকেই। এ ব্যাপারে অনেক আগে থেকেই উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা জানিয়ে আসছে জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা।
প্রেসিডেন্ট বাইডেন যদি সরকারিভাবে ও ব্যক্তিগতভাবে সেসব উদ্বেগের বিষয়ে আরও জোরালো পদক্ষেপ নিতেন, তাহলে অনেকের মৃত্যু রোধ করা যেত। কর্মকর্তারা বলছেন, গত ডিসেম্বরে প্রথম যখন সতর্কতা সংকেত দেয়া হয়েছিল, তখন সীমান্তের আরও স্থল ক্রসিং খোলার জন্য ইসরাইলের উপর যুক্তরাষ্ট্র চাপ অব্যাহত এবং ত্রাণ সরবরাহ চালু রাখলে গাজার দুর্ভিক্ষ থামানো যেত।
কিন্তু বাইডেন ইসরাইলকে মার্কিন সামরিক সহায়তা দানকে শর্তসাপেক্ষ করতে অস্বীকার করেন। পরিবর্ত তার সরকার এয়ারড্রপস তথা বিমান থেকে ত্রাণ ফেলা এবং গাজায় ভাসমান বন্দর নির্মাণের মতো সময়সাপেক্ষ ও অকার্যকর উপায় অনুসরণের সিদ্ধান্ত নেয়।
সারা বিশ্বই এখন জানে যে, এয়ারড্রপস তথা বিমান থেকে ত্রাণ ফেলার কার্যক্রম পুরোটাই ব্যর্থ হয়েছে। এদিকে সংঘাতের সাত মাস পার হয়ে গেলেও গাজায় অস্থায়ী বন্দর তৈরির কাজ এখনও শেষ হয়নি। যার ফলে গাজায় দুর্ভিক্ষ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।
ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামের তথ্য মতে, গাজার উত্তরে প্রায় ৩ লাখ ফিলিস্তিনি এখন সম্পূর্ণ দুর্ভিক্ষের মধ্যদিয়ে যাচ্ছেন এবং ২৩ লাখ জনসংখ্যা বিপর্যয়কর মাত্রার ক্ষুধার সম্মুখীন হয়েছেন।