ছাত্র হত্যা করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠা করা যায় না!
একটি শ্লোগানকে কেন্দ্র করে সারা দেশ তোলপাড়! আন্দোলনকে নষ্ট করার জন্য শ্লোগানটির খন্ডিত অংশ প্রচার করে শাসকগোষ্ঠী ফায়দা হাসিলে তৎপর। শ্লোগানটি ছিলো, “আমি কে? তুমি কে? রাজাকার, রাজাকার! কে বলেছে? কে বলেছে? স্বৈরাচার, স্বৈরাচার!”।
এখন শাসক দলের পক্ষ থেকে এই শ্লোগানের খন্ডিত অংশটি (প্রথম অংশটুকু) প্রচার করা হচ্ছে। এবং বলা হচ্ছে ছাত্ররা নিজেদেরকে রাজাকার দাবী করেছে! এটাই যেকোন গণতান্ত্রিক আন্দোলন নসাৎ করার একটা কমন বিষয়।
ছাত্রদের এই শ্লোগান দেওয়ার প্রেক্ষাপটটি কী? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁর চীন সফরের পরে সাংবাদ সম্মেলনে বলেন, “মুক্তিযোদ্ধাদের নাতিপুতিরা পাবে না? তাহলে কি রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে!”। তাঁর এই বক্তব্যের মাধ্যমে এটা স্পষ্টতই কোটা সংস্কার আন্দোলনরত ছাত্রদেরকে রাজাকারের নাতিপুতি বলে কটাক্ষ করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর কটাক্ষে ক্ষীপ্ত হয়েই ছাত্রদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এই শ্লোগানের মাধ্যমে। এবং পুরো শ্লোগানটি শুনলেই বোঝা যাবে ছাত্ররা নিজেদেরকে একবারও রাজাকার বলে নাই। বরং তাদেরকে যে রাজাকার এর নাতিপুতি বলে ইঙ্গিত করা হয়েছে তার প্রতিবাদ জানিয়েছে তাঁরা।
ছাত্রদের এই শ্লোগানকে ইস্যু করে সারা দেশে ছাত্রলীগ আন্দোলনকারী ছাত্রদেরকে নির্মমভাবে পিটিয়েছে। যে বর্বরতা ’৭১ সালের পাকহানাদার ও রাজাকার-আলবদর-আলসামস বাহিনীর সাথে তুলনীয়!
১৫ জুন রাত নয়টা পর্যন্ত শুধুমাত্র ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন ২৯৭ জন শিক্ষার্থী। ইতিমধ্যেই সারা দেশে নিহত হয়েছেন ৬ জন। রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালসহ সারা দেশে আরো বহু সংখ্যক ছাত্র ছাত্রলীগ নামধারী এই দানবদের হামলার শিকার হয়েছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,আপনি ১৪ জুলাই সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন,“মুক্তিযোদ্ধারা বিজয় এনে দিয়েছিলো বলেই তো আজকে সবাই উচ্চপদে আসীন। আজকে গলা বাড়িয়ে কথা বলতে পারছে। নইলে তো পাকিস্তানিদের বুটের লাথি খেয়ে চলতে হতো”।
ঠিক তার একদিন পরেই আপনাকে সাংগঠনিক নেত্রী মানা সংগঠন ছাত্রলীগ আন্দোলনকারী সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের উপর যেভাবে বর্বর অত্যাচার করলো সেটার সাথে আপনার বক্তব্যোর কোন সাদৃশ্য থাকলো কি??
আসলেই কি গলা বাড়িয়ে কথা বলার অধিকার অর্জিত হলো? আজকের ২০২৪ সালের বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের বুটের লাথির পরিবর্তে আপনার ছাত্রলীগের সোনার ছেলেদের লাথি মারার, গুলি করে আন্দোলনকারীদের হত্যা করার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলো।
১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রসমাজ তথা জনগণের উপর এই একই ধরণের নিপীড়ন চালাতো। তখন সেই নিপীড়নের জাস্টিফিকেশন দেওয়ার জন্য তাদের পক্ষ থেকেও একইভাবে বলা হতো, জনগণের জানমালের নিরাপত্তা রক্ষা এবং দেশের অখন্ডতা বজায় রাখার জন্য তারা দায়িত্ব পালন করছে।
আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠীও একই বক্তব্য উপস্থাপন করছে এই আন্দোলনকে বল প্রয়োগে দমনের জাস্টিফিকেশন হিসাবে। গত ৫৩ বছরে যখন যারা ক্ষমতায় থেকেছে প্রত্যেকেই এই একই ভাষা ব্যবহার করেছে। অথচ একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন দেশের সরকারগুলির ভাষা এমন হওয়ার কথা ছিলো না।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান এসব কি বায়বীয় কোন বিষয়? মোটেও বায়বীয় কোন ব্যাপার না। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান কোটায় আবদ্ধ কোন বিষয় না। মুক্তিযোদ্ধারা যে স্বপ্ন নিয়ে; আকাঙ্খা নিয়ে সেদিন নিজেদের জীবনকে উৎসর্গ করে এই দেশটাকে একটি পতাকা এনে দিয়েছিলো, একটি পৃথক মানচিত্রের জন্ম দিয়েছিলো।
একটি গনতান্ত্রিক দেশ প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছিলো। তার পরিণতি কি সরকারী দলের সমর্থনপুষ্ট ছাত্র সংগঠন সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের উপর হায়েনার মতো ঝাপিয়ে পড়ে তাদেরকে ক্ষত-বিক্ষত করে তোলা?
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চেতনা, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ছিলো পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। একটি অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পাবার প্রত্যাশায় ৩০ লাখ শহীদ তাঁদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।
পরিতাপের বিষয়, তাদের রক্তে অর্জিত এই দেশ যারা ৫৩ বছর ধরে শাসন করছে তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পরিপূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। বরং উত্তরাধিকার সূত্রে তৎকালিন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর তারা পদাঙ্ক অনুসরণ করেছে।
অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবাহান তাঁর ‘বাংলাদেশের অভ্যুদয়’ বই এ লিখেছেন, ‘গণমানুষের এই সর্বাত্বক অংশগ্রহণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে একধরনের অন্য অধিকাংশ সংগ্রাম থেকে স্বাতন্ত্র্য এনে দিয়েছে। ঠিক এ কারণেই এ দেশে এমন একটা সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার দরকার ছিলো, যেখানে এই মানুষগুলো তাদের অবদানের স্বীকৃতি পায় এবং তারা একটি আধুনিক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে। তার পরিবর্তে আমরা এমন এক সমাজ গড়ে তুললাম, যা উত্তরাধিকার সূত্রে আমরা যে সমাজটি পেয়েছিলাম তার চেয়েও অধিক বৈষম্য পিড়িত’।
মাননীয়,কেন স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরে এসেও আপনাদেরকে “মুক্তিযুদ্ধ বনাম রাজাকার” এটাকে উপজীব্য করে রাজনীতি করতে হয়? কেন বতর্মান প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে যে পরিমাণ স্পর্শকাতর হওয়ার কথা সেটা হচ্ছে না? আপনাদের লুটেরা রাজনীতির কারণেই এটা সম্ভব হয়নি। আপনারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে দৃশ্যমান করতে ব্যর্থ হয়েছেন। ৫৩ বছর কেন; এভাবে যদি ১০০ বছরও পার করেন তারপরেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যর্থ হবেন।
গত টানা ১৫ বছর ধরে মুক্তিযুদ্ধের সোল এজেন্ট দাবীদার রাজনৈতিক দলটি রাষ্ট্র ক্ষমতায়। অথচ ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পরেও হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রীদেরকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে, হত্যা করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করতে হচ্ছে আপনাদের!! মুক্তিযুদ্ধর চেতনা বাস্তবায়নের এই ভ্রান্ত এবং আত্মঘাতি পদ্ধতি নতুন প্রজন্মের মধ্যে শুধুই ঘৃণার জন্ম দিচ্ছে।
৭১ সালের পরাজিত শক্তির দোসর রাজাকারের মতাদর্শে আজকের প্রজন্ম দিক্ষিত হবে এর বাস্তব কোন কারণ নেই! কিন্তু আট হাজার ভূয়া মুক্তিযোদ্ধার তালিকা; মুক্তিযোদ্ধাদের নামে প্লট বরাদ্দের দুর্নীতি; এমনকি মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য বিদেশী বন্ধুদের জন্য যে স্বর্ণের ক্রেস্ট তৈরি করা হলো, সেখানে জালিয়াতি কারা করলো??
কোন সরকারের আমলে এসব ঘটেছে? এসবে তো মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মান হয় না! কোটা সংস্কারের আন্দোলনে ছাত্রলীগের সাথে সংঘর্ষে একদিনে ৬ জন নিহত হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরাট সম্মান অক্ষুণ রাখা হয়!!
ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে এই সরকারের আমলে যারা অন্তর্ভূক্ত হয়েছে তাদের প্রসঙ্গে মাননীয় মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রী বিবিসি বাংলাকে বলেন,“ যারা ভাতা পেতেন সেটা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে তবে এই বিষয়ে মামলা করলে হাজার হাজার লোকের বিরুদ্ধে করতে হবে। আমরা মন্ত্রণালয় চালাবো নাকি আদালতের বারান্দায় বারান্দায় দৌঁড়াবো”। এতে তো মুক্তিযোদ্ধারা অনেক সম্মানিত হলেন,কি বলেন?
কোটা সংস্কারের একটি শান্তিপূর্ণ আন্দোলন আজকে ক্ষমতাসীনদের অদক্ষতার কারণেই এমন একটি রক্তক্ষয়ী পর্যায়ে রুপ নিয়েছে। তারা আন্দোলনকে বিতর্কিত করার জন্য “রাজাকার” ইস্যুকে স্টাবলিশ করেছে; সেটাকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগকে নামিয়ে দিয়েছে বল প্রয়োগ করে আন্দোলন দমনের জন্য।
ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাহেব বলেছেন, “গতকাল রোববার রাতে ক্যাম্পাসে যে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ হয়েছে, তার জবাব দেওয়ার জন্য ছাত্রলীগ প্রস্তুত। ”এমন ভাবে প্রস্তুত করলেন যে, একদিনেই দেশের বিভিন্ন স্থানে ৬ জন নিহত হলেন! এই ৬ টি প্রাণ যে চলে গেলো এর দায়-দায়িত্ব কে নিবে?
আপনারা আন্দোলনকারীদের আলোচনায় বসার আহ্বান জানাতে পারতেন।
ছয়টি প্রাণ ঝরে যাওয়ার পর আজকে ১৬ তারিখে আপনারা আলোচনার আহ্বান জানিয়েছেন। একটি আন্দোলনে বিভিন্ন অংশ বিভিন্নভাবে ক্রিয়াশীল হতে পারে। কিন্তু সেটি দক্ষতার সাথে মোকাবেলা করার দায়িত্ব তো সরকারের থাকে। আপনারা সেটি না করে ছাত্রলীগকে দিয়ে আন্দোলন দমনের সেই পুরানো পথে হাটলেন যা বিগত দিনে যখন যে ক্ষমতায় থেকেছে তাদের মতো করেই।
শাসকগোষ্ঠীর রাজনৈতিক দলের বৈশিষ্ট্যগুলি খুবই কমন। কারণ তাদের শ্রেণিচরিত্র এক ও অভিন্ন। মাননীয়, আপনারা যে পথে হাটছেন এই পথে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন একটা সুদূর পরাহত ব্যাপার। বরং যা করছেন তা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকেই ভুলন্ঠিত করছেন!
ভাবতে কষ্ট হচ্ছে প্রগতিশীল সেই সকল বন্ধুদের কথা ভেবে, যারা বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের শ্লোগানের অন্তর্হিত অর্থ বুঝতে ব্যর্থ হলেন! যারা ক্ষমতাসীনদের দৃষ্টিতে পুরো বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করলেন।
এই ব্যর্থতার কারণেই বাংলাদেশকে গণমানুষের বাংলাদেশ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে তারা ভূমিকা রাখতে যেমন ব্যর্থ হয়েছেন বিভিন্ন সময়ে; একইসাথে শাসকগোষ্ঠীর হাতকে শক্তিশালী করতে ভূমিকা রেখে চলেছেন।
মাননীয়গণ, আপনারা বিস্মৃত হয়েছেন! এই তরুণ প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনাতেই উজ্জীবিত। তার জন্যই তাঁরা বিক্ষুব্ধ হয়েছেন। মৃত্যুভয়কে তুচ্ছকরে আন্দোলনকে অগ্রসর করেছেন। নিজেদের জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন। রাজাকারের চেতনা বহন করে গুলির মুখে নিশ্চলভাবে দাঁড়িয়ে গুলিবিদ্ধ হওয়া যায় না! নিজের জীবনকে উৎসর্গ করা যায় না! মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় তাকে সেই শক্তি যুগিয়েছে!