বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় জনপ্রিয় হওয়া অন্যতম একটি গান “মাগো ভাবনা কেন, আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে, তবু শত্রু এলে অস্ত্র হাতে ধরতে জানি”। দেশকে মা কিংবা নারী হিসেবে কল্পনা করার রেওয়াজ নতুন নয়। ঐতিহ্যগত ভাবেই দেশের ভূমিকে আমরা মাতৃভূমি বলি। আমরা মনে করি,দেশে আমরা জন্ম নিই তাই দেশ আমাদের জননীই ।
ইউরোপের অনেক দেশে, বিশেষত জার্মানিতে দেশকে তাঁরা বলেন ফাদারল্যান্ড। কিন্তু আমাদের জন্য দেশ মাদারল্যান্ড। জেন্ডার্ড পরিচয়ের বাইরে বের হবার চেষ্টা না করে দেশকে চিরকাল নারী হিসেবে ধরে নেওয়া আমরা দেশের নাগরিকদেরও ‘শান্ত ছেলে’ বা পুরুষ হিসেবেই ভেবে এসেছি। নারী এই সমাজে ‘আদার’ কিংবা ‘অপর’ হয়ে রয়ে গেছেন। একইভাবে দেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামো কখনওই নারী নয়, এমনকি নারীবান্ধবও নয়। সমাজ আর ধর্মের কাছেও পুরুষ কেন্দ্রীয় আর নারী প্রান্তিক।
জুলাই আগস্ট গণ অভ্যুত্থান শুরু হয়েছিল কোটা সংস্কার আন্দোলন দিয়ে। মাসব্যাপী সংগ্রামের পর যে ফলাফল পাওয়া গেলো তাতে নারী কোটা সম্পূর্ণ তুলে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের নারীরা আর প্রান্তিক, পশ্চাদপদ কিংবা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী নন, বরং তাঁরা পুরুষের সমান সকল সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকেন এমন ধরে নেওয়া অযৌক্তিক শুধু নয়, মূর্খতার শামিল বলে আমি মনে করি। বাংলাদেশের সংবিধানে ২৮ (খ) অনুচ্ছেদে নারী আর পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলা হলেও সেটির বাস্তব প্রয়োগ আমরা দেখতে পাইনি। নারী পারিবারিক সম্পত্তিতে অধিকার পান না, তাঁর চলাফেরা এবং নিরাপত্তার নিশ্চয়তা রাষ্ট্র দিতে পারেনি। বিবাহ, তালাক, সন্তানের অভিভাবকত্ব, সবেতন মাতৃত্বকালীন ছুটির মতন অনেক ব্যাপারে নারী বৈষম্যের শিকার হন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব ব্যাপারে আইনি সাহায্য নিতে হলেও নারীকে এনজিও বা অন্য কোন দাতব্য প্রতিষ্ঠানের শরণাপন্ন হতে হয়।
আপনাদের হয়তো মনে আছে বছরখানেক আগে রিফাত হত্যা মামলায় জড়িত থাকার সন্দেহে মিন্নি নামের এক নারী গ্রেপ্তার হন যিনি ছিলেন রিফাতের স্ত্রী। আত্মপক্ষ সমর্থন করার জন্য কোন আইনজীবী পাচ্ছিলেন না তিনি। মামলার কোন সুরাহা হবার আগেই মিন্নি রিফাত ও নয়ন বন্ডের ত্রিভুজ প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে পরাণ নামে একটি চলচ্চিত্র মুক্তি পায় যেখানে রিফাত হত্যার দায় চাপানো হয় মিন্নির উপর। ছবিটির ট্রেইলারে শুরুতে সত্য ঘটনার উপর ভিত্তি করে লেখা ছিল, পরবর্তীতে সেটি তুলে দেওয়া হলেও বিদ্যা সিনহা মীম আর শরিফুল রাজ অভিনীত সেই ছবিটি যে রিফাত মিন্নির গল্প বলছে সেটি বুঝতে কারো বাকি থাকে না।
প্রাথমিকভাবে এক নম্বর সাক্ষী মিন্নিকে চার্জশিট তৈরি হবার সময় অভিযুক্তের তালিকায় রাখা হয়। চলচ্চিত্রটির উল্লেখ এজন্য করলাম যে, জনমানসে নারীবিদ্বেষ যতটা তীব্র হলে মামলার রায় হবার আগেই একজন নারীকে দোষী বলে প্রমাণ করে এক ধরনের হাইপার রিয়েলিটি তৈরি করার প্রবণতা সমাজে প্রচলিত সেটির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা। তিনি অপরাধী হলেও আইনি সহায়তা পাওয়ার অধিকার তাঁর ছিল। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা তাঁর এই সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করতে পারেনি। জেলহাজতে থাকা অবস্থায় মিন্নির উপর বিভিন্ন নির্যাতনের সংবাদ পাওয়া গিয়েছে। অপরাধ প্রমাণিত হবার আগেই কাউকে সাজাপ্রাপ্ত আসামী হিসেবে ধরে নেওয়া যায় না। আর সাজাপ্রাপ্ত আসামী হলেও যে কোন নাগরিকের অধিকার আছে প্রশাসনের কাছ থেকে সদয় আচরণ পাওয়ার। অথচ সাধারণ নারী থেকে শুরু করে একদা ক্ষমতাসীন নারীরাও সেটি পান না।
বাংলাদেশের ইতিহাসে অধিকাংশ সময়েই রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন নারী। প্রথমবার নির্বাচিত হন খালেদা জিয়া, এরপর শেখ হাসিনা, আরও এক দফা খালেদা জিয়া এবং তার পর থেকে শেখ হাসিনাই প্রধানমন্ত্রীর দায়ত্ব পালন করে আসছেন। সংসদে বিরোধীদলীয় নেতার স্থান দখল করে ছিলেন নারী, সম্প্রতি সংসদের স্পিকার পদেও নারীকে বহাল হতে দেখেছি আমরা। জাহাঙ্গীরনগর এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী উপাচার্য নিযুক্ত হবার মতন ঘটনাও ঘটেছে, যা কিনা ইতিবাচক পরিবর্তন হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন অনেকে।
কিন্তু রাষ্ট্র এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মতন প্রতিষ্ঠানগুলোর পুরুষতান্ত্রিক চরিত্র পাল্টাতে আমরা দেখিনি। সমাজে তীব্র নারীবিদ্বেষ প্রচলিত থাকা অবস্থায় জৈবিকভাবে একজন নারী উচ্চপদে আসীন হলেও আদতে কিছুই পরিবর্তিত হয় না। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে পুরুষতান্ত্রিকতা ব্যক্তির জৈবিক পরিচয়ের উপর নির্ভরশীল নয়, এটি একটি ব্যবস্থা । জৈবিকভাবে একজন পুরুষ যেমন চাইলে পুরুষাধিপত্যবাদী না হয়ে নারীবাদী হতে পারেন, নারীবান্ধব হতে পারেন ঠিক সেভাবেই একজন জৈবিক নারীও হতে পারেন প্রচণ্ড পুরুষতান্ত্রিক। আমাদের নারী নেতাদের ক্ষেত্রেও ঠিক এটিই ঘটেছে।
গত পনের বছরের আওয়ামী শাসনামলে বাংলাদেশের মানুষের বাকস্বাধীনতা আর মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে প্রচন্ডভাবে। বিএনপি চেয়ার পারসন খালেদা জিয়া, যিনি বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিলেন, তিনিও ন্যুনতম মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী পরিচয় বাদ দিলেও তিনি একজন সিনিয়র সিটিজেন, অশীতিপর বৃদ্ধা, প্রায় মৃত্যুপথযাত্রী একজন নারী। তাঁকে যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া যায়নি সরকারের প্রতিহিংসামূলক রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে।
অথচ চিকিৎসা পাওয়া একজন নাগরিকের মৌলিক অধিকার। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন সময়ে তাঁর সাজপোশাক, তাঁর মেকআপ নিয়ে বিরোধীরা ঠাট্টা তামাশা করেছেন, তাঁকে ‘মোবাইল বিউটি পার্লার’ বলে সম্বোধন করেছেন। খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে কিংবা সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়াকে স্লাট শেইমিং করেছেন বহুবার, জনসমক্ষে তামাশা করেছেন মোসাদ্দেক হোসেন ফালুর সঙ্গে জড়িয়ে। তিনি এটাও বলেছেন যে মুক্তিযুদ্ধের পর ক্যান্টনমেন্ট থেকে ফিরে আসা খালেদা জিয়াকে তাঁর স্বামী জিয়াউর রহমান ঘরে তুলতে চাননি, শেখ মুজিবের কাছে নালিশ করার জন্য খালেদা জিয়া তাঁদের বাড়িতে গিয়ে ‘পড়ে থাকতেন’।
তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া ‘বীরাঙ্গনা’ খেতাবটি দিয়েই খালেদা জিয়াকে অপমান করার চেষ্টা করেছেন শেখ হাসিনা। মুক্তিযোদ্ধা কোটা থাকবে কি থাকবে না সেই বিতর্কের জের ধরে এত বড় অভ্যুত্থান হয়ে গেল অথচ বীরাঙ্গনাদের ব্যাপারে কেউ কোন কথা বলেনা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়েও হয়েছে বহু তোলপাড় কিন্তু বীরাঙ্গনাদের খোঁজ খবর কেউ রাখেনি কখনো।
সামাজিকভাবে বীরাঙ্গনা খেতাবটি একটি লজ্জা অপমানের ব্যাপার হয়ে গিয়েছে সমাজের পুরুষতান্ত্রিক চর্চার কারণে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক নিপীড়িত নারীদের জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া এই অভিধাটি সামাজিকভাবে যেরকম গ্লানিকর বলে বিবেচিত হয়েছে, রাষ্ট্রও ভিন্ন কোন অবস্থান নেয়নি। সরকার প্রধান নিজে নারী হয়েও নিজের পিতার দেওয়া এই দয়ার্দ্র আর সহানুভূতিশীল অভিধাটিকে নারীর বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবেই ব্যবহার করেছেন।
নারীবিদ্বেষী সংস্কৃতির চর্চা অব্যহত রাখলে যা হয়, এই ঘৃণা আর পৌরুষিকতার প্রয়োগ খুব সহজ আর স্বাভাবিক হয়ে যায়। একে আলাদা করে প্রশ্ন করার কোন অবকাশই আর থাকে না। ঠিক এই কারণেই পদত্যাগের পর শেখ হাসিনাকে নিয়েও বিভিন্ন জোক, মিম আর কার্টুন ছড়িয়ে পড়েছে। এদের মধ্যে কিছু কিছু অত্যন্ত আপত্তিকর। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে শেখ হাসিনা আর নরেন্দ্র মোদিকে জড়িয়ে আদিরসাত্মক ফাজলামি। গণভবন লুণ্ঠনের সময় তাঁর অন্তর্বাস নিয়ে প্রকাশ্যে উল্লাস করেছে কিছু অসংবেদনশীল তরুণ। এই সবই সমাজে বিদ্যমান নারীঘৃণার প্রমাণ, রাষ্ট্রের পুরুষতান্ত্রিক প্রবণতার ফসল।
রাষ্ট্রীয় কাঠামো থেকে পুরুষতান্ত্রিকতা হঠানো না গেলে, সামাজিকভাবে নারীবিদ্বেষ দূর করা না গেলে রাষ্ট্রের উচ্চতম পদে, সংসদের, বিশ্ববিদ্যালয়ের, কর্পোরেট অফিসের প্রধান ব্যক্তির পদগুলোতে নারীরা বসলেও সত্যিকার কোন পরিবর্তন আসবে না। সেই নারীরা পুরুষতন্ত্রের এজেন্ট হিসেবেই কাজ করবেন এবং একটি কৃত্রিমভাবে দেখানো সমতার ভুল ধারণা তৈরি হবে যাতে করে নারী কোটা তুলে দেওয়ার মতন অন্যায্য সিদ্ধান্তকে জায়েজ করা যাবে।