মায়ের ভাষার অধিকার কেড়ে নেওয়ার প্রতিবাদে পাকিস্তানি শাসকদের বুলেটের সামনে প্রাণ দানকারী সূর্যসন্তানদের ব্যতিক্রমীভাবে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করতো নড়াইলের মানুষ। প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারী সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে নড়াইল শহরের কুরিরডোব মাঠে প্রায় ৩ হাজার শিশু-কিশোর মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করতো এবং কয়েক মিনিটের মধ্যেই গোটা মাঠে জ্বলে উঠতো লাখো মোমবাতি। এই সাথে নড়াইলের শিল্পীরা বিষাদমাখা চিরচেনা সেই-‘আমার ভায়ের রক্ত রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারী/ আমি কি ভুলিতে পারি’ গানের মধ্য দিয়ে ১ঘন্টাব্যাপি গণসংগীত পরিবেশন করতেন। মাঠে শুধু লাখো মোমবাতিই জ্বালানো হতো না। প্রতি বছরই আয়োজনকে নান্দনিক করার জন্য পরিবর্তন আনা হতো। কোন বছর মাঠের মধ্যে বিশাল কৃত্রিম পুকুর তৈরি করে সেখানে মাটির প্রদীপ জালায়ে ভাসমান আলোকসজ্জ্বা তৈরি, আবার মাঠের মাঝখানে উঁচু ডিবি তৈরি করে কাঠের শহীদ মিনার করে সেখানে মোমবাতি জ্বালানো হতো এবং তার চারপাশে হৃদের মতো তৈরি করে হৃদের পানিতে মাটির প্রদীপ, কশসিট ও কলা গাছের গুঁড়িতে মোমবাতি জালিয়ে পানিতে ভাসিয়ে দেয়া হতো। পানির মধ্যে বিশেষ ব্যবস্থায় জালোনো হতো লাইট । আবার মাঠের মধ্যে কাঠ ও কলা গাছ দিয়ে শহীদ মিনার তৈরি, ঘাসের ওপর সারা মাঠ জুড়ে বাংলা বর্ণমালা ও বিভিন্ন ধরনের আল্পনা ও বাংলার চিরায়ত বিভিন্ন লোকশিল্প আঁকা হতো। এই সাথে ফানুস ওড়ানো হতো। কমপক্ষে ১৫ হাজার মানুষ মনোরম এ দৃশ্য উপভোগ করতেন।
একুশের আলো নড়াইলের আয়োজনে দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে এ ব্যতিক্রমী অনুষ্ঠান চলে আসলেও এবার ২১ ফেব্রুয়ারী তার ব্যত্যয় ঘটলো। এবার শহীদদের উদ্দেশ্যে এ স্মরণ অনুষ্ঠান হলো না। ‘অন্ধকার থেকে মুক্ত করুক একুশের আলো’ এ শ্লোগানকে সামনে নিয়ে ১৯৯৮ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী থেকে নড়াইল শহরের কুরিরডোবের ৬ একরের বিশাল মাঠে ভাষা শহীদদের স্মরণে লাখো মোমবাতি জ্বালিয়ে ব্যতিক্রমি এ আয়োজনটি শুরু হয়। এ আয়োজন সফল করতে ১মাস পূর্ব থেকে সাংস্কৃতিক কর্মী ও সেচ্ছাসেবক প্রস্তুতি নিতেন। নড়াইল, যশোর, খুলনাসহ বিভিন্ন জেলা থেকে ১৫ হাজারের বেশী মানুষ এ অনুষ্ঠানটি উপভোগ করতেন। কিন্তু এবার তার ব্যতিক্রম হলো।
একুশের আলোর মাঠ কর্মী রাহাতুল ইসলাম বলেন, প্রতি বছর মোমবাতি প্রজ্জ্বলনের এই কাজটি করতাম। কয়েক’শ স্বেচ্ছাসেবক আয়োজনটিকে সফল করতে নিরলসভাবে কাজ করতেন এবং ২১-এর সন্ধ্যায় প্রায় ৩ হাজার শিশু-কিশোর এ মোববাতি জ্বালাতেন। এবার অনুষ্ঠানটি না হওয়ায় কর্মীদের মন খারাপ।
বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সাইফুর রহমান হিলু বলেন, লাখো মোমবাতি জ্বালিয়ে ভাষা শহীদদের স্মরণ ছিল অদ্ধকার থেকে আলোয় আসার আহবান। এটি কোন গোষ্ঠী বা দলের আয়োজন ছিল না। অনুষ্ঠানটি সার্বজনীন। ইন্টারনেটের কারণে নান্দনিক এ আয়োজনটি স্থানীয় পর্যায় পেরিয়ে জাতীয় এমনকি সারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ উপভোগ করতো। কিন্তু দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটের কারণে সাংস্কৃতিক কর্মীরা হয়তো খুব চাপের মুখে রয়েছে যে কারণে অনুষ্ঠানটি হলো না। এতে বাঙ্গালি চেতনার জায়গাটি বিগ্নিত হলো। আশা করি আগামিতে আয়োজনটি আবার আলোর মুখ দেখবে।
এ বিষয়ে একুশের আলোর সাধারণ সম্পাদক নাট্য ব্যক্তিত্ব কচি খন্দকার বলেন, প্রতি বছরের মতো এবারও আমরা একুশের আয়োজন করার জন্য প্রস্তুত ছিলাম কিন্তু দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আমরা একুশের অনুষ্ঠান করছি না।