অচল দুই পা, চলাফেরা করতে পারেন না ,তবুও থেমে নেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন দেখা টুটুল নামের এক কিশোরের। হুইলচেয়ারে বসে নয়, বরং নিজের চালানো তিন চাকার ছোট্ট মটর গাড়িতে করে এসে অংশ নিলেন গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘এ’ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায়। বলছি শামীমুর রহমান টুটুলের কথা যিনি শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নয়, দেখাতে চান আত্মবিশ্বাস আর ইচ্ছাশক্তির জয়গাথা।
পাবনার টেবুনিয়ার এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেয়া টুটুল ছোটবেলা থেকেই দুরারোগ্য মাসকুলার ডিস্ট্রফি রোগে আক্রান্ত। এটি একটি জিনঘটিত পেশির রোগ, যার ফলে শরীরের পেশি ধীরে ধীরে দুর্বল ও ক্ষয়প্রাপ্ত হতে থাকে। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় কোমর থেকে নিচের অংশ সম্পূর্ণভাবে অবশ হয়ে যায় টুটুলের। হুইলচেয়ারের জীবন তখনই শুরু, সঙ্গে নিঃসঙ্গতা আর সীমাহীন শারীরিক যন্ত্রণা। কিন্তু সেই কষ্টে থেমে যায়নি টুটুলের স্বপ্ন দেখা। মা চম্পা খাতুন হয়ে ওঠেন তার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা, সবচেয়ে নির্ভরতার আশ্রয়।
মায়ের হাত ধরে টুটুল শুরু করে জীবনের দ্বিতীয় যুদ্ধ শিক্ষা দিয়ে নিজেকে প্রমাণ করার লড়াই। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অর্জন করে জিপিএ ৫। এরপর এইচএসসি পরীক্ষায় পেয়েছে ৪.৬০ জিপিএ। প্রতিদিনের সীমাবদ্ধতা আর সমাজের অবহেলাকে পিছনে ফেলে সে প্রস্তুতি নেয় বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির জন্য।
প্রচলিত কোচিং বা শিক্ষকের কাছে গিয়ে ক্লাস করার সুযোগ হয়নি। ঘরে বসেই নিজের চেষ্টা আর ইউটিউবের সহায়তায় প্রস্তুতি নিয়েছে। চলাফেরায় সীমাবদ্ধতা থাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেনি।তবে টেবুনিয়া থেকে বিশ্ববিদ্যালয় মাত্র কয়েক কিলোমিটারের দূরত্ব হওয়ায় গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেন তিনি।
শুক্রবার মাকে সঙ্গে নিয়ে তিন চাকার নিজস্ব মটর গাড়ি চালিয়ে সে হাজির হয় পাবিপ্রবি কেন্দ্রে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে। ভর্তি পরীক্ষা শেষে টুটুল বলেন, আমার শরীর হয়তো থেমে গেছে, কিন্তু স্বপ্ন থেমে নেই। আমার বড় ভাইয়েরও আমার মতোই পা প্যারালাইজড। কিন্তু তিনি থেমে থাকেননি। পাবনার এডওয়ার্ড কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্স শেষ করেছেন। তিনি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। তাকেই দেখে বুঝেছি, শরীরের সীমাবদ্ধতা মানুষকে আটকে রাখতে পারে না, যদি মনোবল থাকে। আমার প্রতিবন্ধকতা আমাকে থামিয়ে রাখতে পারেনি, কারণ আমার মা সবসময় আমার পাশে থেকেছেন। মা ছিলেন বলেই এই জীবনটা এতটা সহজ মনে হয়েছে। তিনি না থাকলে হয়তো আমি এতদূর আসতেই পারতাম না।”
টুটুল আরো বলেন, আমি জানি, এই রোগ সময়ের সঙ্গে আরো বাড়বে। কিন্তু আমি ভয় পাই না। কারণ আমি জানি, আমার মা আছেন, আমার পরিবার আমার পাশে আছে। আমি বিশ্বাস করি, যদি কেউ সত্যিকার অর্থে চেষ্টা করে, তাহলে পৃথিবীর যেকোনো প্রতিবন্ধকতা জয় করা সম্ভব।
টুটুলের মা চম্পা খাতুন বলেন, আমার বড় ছেলেকে কলেজে পড়াতে অনেক কষ্ট করেছি। কেউ পাশে দাঁড়ায়নি। নিজেই কাঁধে করে নিয়ে গেছি, বই কিনে দিয়েছি। কিন্তু ছোট ছেলেকে পড়াতে গিয়ে মানুষ পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
তিনি আরো বলেন, আমি শুধু চাই, আমার এই ছেলেটা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাক। ঐ স্বপ্ন যেন থেমে না যায়। আমি সারা জীবন এই দুই ছেলেকে নিয়ে লড়েছি, এখন শুধু চাই ওরা শিক্ষিত হয়ে সমাজের বোঝা নয়, উদাহরণ হয়ে উঠুক। ছেলেটা যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে, আমার সব কষ্ট সার্থক হবে। আমি সবার কাছে দোয়া চাই।’