Homeমতামতহতাশার বিপরীতে সফলতার রোডম্যাপ

হতাশার বিপরীতে সফলতার রোডম্যাপ

মানুষের জীবন এক জটলা সুতার পিন্ডবিশেষ। কেউ কেউ নিরন্তর প্রচেষ্টা ও নিরলস শ্রমের মাধ্যমে এই সুতাপিন্ডের জটলা জয় করতে সম্ভব হয় আর কারো পক্ষে পিন্ডের ভাঁজ বুঝতে বুঝতেই জীবন নিমজ্জিত হয় হতাশার অথৈ সাগরে। বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন তার বিবর্তনবাদ তত্ত্বে উল্লেখ করেন – জেব্রা এবং জিরাফ উভয়ই জন্মগতভাবে একই শ্রেণীভুক্ত প্রাণী ছিলো এবং তাদের গঠনও একই রকম ছিলো অর্থাৎ তারা নিচু হয়ে মাটি থেকেই ঘাস খেতো। একদিন জিরাফ ভাবলো, নিচে যেহেতু ঘাস পাওয়া যাচ্ছে না, গলা বাড়িয়ে উপরের দিকে চেষ্টা করা যাক, একদিন দুদিন এরূপ চেষ্টার পর কালক্রমে জিরাফ এর গলা লম্বা হতে থাকলো এবং বংশানুক্রমে একসময় জিরাফ হয়ে ওঠলো ১৯ ফুট দীর্ঘ গলার অধিকারী এক প্রাণী যে কিনা নিচু হয়েও ঘাস খেতে পারে আবার উঁচু হয়েও লতাপাতা খেতে পারে। ডারউইন বলেন, জিরাফের এই বিবর্তন ছিলো সম্পূর্ণ তার মানসিক চেতনা কিংবা মন থেকে উঁচু হওয়ার ঐকান্তিক চেষ্টার ফসল।

হাজারো চেষ্টার ফলে যে মানুষগুলো হতাশার বেড়াজালে আটকে গেছে, তাদের জন্যেই জীবনের কিছু শ্বাশত সত্য জেনে রাখা উচিত বলে আমি মনে করি।

প্রথমত, জগতে কাউকে খুব বেশি সুখী কিংবা সফল ভাবা সম্পূর্ণ ভুল কাজ। প্রাচীন যুগে সবচেয়ে সুখী ভাবা হতো রাজ্যের বাদশাহ-কে। অথচ আগে-পরে বাদ হয়ে যাবেন বলেই তার নাম হয়েছে “বাদশাহ”। তুরস্কের ভাষায় একে বলা হয় “পাদশাহ” যার নির্গমন অধিকতর দুর্গন্ধযুক্ত। সত্যিকার অর্থে, সমাজের কথিত সফলতার চেয়ারে বসে কেউই আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলতে পারে না। কাজেই সুখ বিষয়টা আপেক্ষিক এবং কাউকে সুখী ভাবাটাও সম্পূর্ণ আমাদের কল্পনানির্ভর। সুতরাং, সুখ যেহেতু কল্পনাপ্রসূত, সেহেতু মানুষের নিজস্ব যা কিছু আছে, তার মধ্যেই মানসিক সুখের যথেষ্ট উপকরণ বিদ্যমান, অভাব শুধু আমাদের খুঁজে দেখার ইচ্ছার। মনের সুখের বাহিরে চিরন্তন আর কিছুই জগতে নেই।

দ্বিতীয়ত, আজকে যাকে আমরা “সফল” বলে পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে অভিনন্দিত করছি। ভেবে দেখুন, সেই পুষ্পাঞ্জলির প্রতিটি ফুলের পিছনেই যুক্ত থাকে এক একটি নারিকেল শলাকা। ফুল খানিকক্ষণ পরেই শুকিয়ে যায় কিন্তু শলাকা ঠিকই জিইয়ে থাকে। অর্থাৎ, ফুলের সুভাষ শেষে শলাকার আঘাতের আভাসের মতোই জগতে প্রতিটি ক্ষেত্রে সুখের ভিতরেই দুঃখের বীজ নিহিত থাকে। তবে আমরা শুধু ফুল স্বরূপ সুখটাই দেখি, কাটা স্বরূপ দুঃখটা আমাদের চোখে পড়ে নাহ্।

তৃতীয়ত, আমাদের জীবন সম্পূর্ণ সমীকরণ নির্ভর। এখানে, সুপরিকল্পিত পরিশ্রম সমান সফলতা। এ বাস্তবতার বাইরে আর কিচ্ছু নেই। আপনি কোনো অজুহাতে পরিশ্রমে যতটুকু ফাঁকি দিবেন, আখেরে সফলতাও আপনাকে ততটুকুই ফাঁকি দিবে। নির্মম হলেও সত্য যে আপনাকে তখন সেটা মেনে নিতেই হবে। সুতরাং, মানবজীবনে প্রত্যাশা ততটুকুই রাখুন, যতটুকু আপনার পরিশ্রম। যথেষ্ট পরিশ্রম করেও যদি কেউ সফল না হয়, বুঝতে হবে এটা তার রাজ্য নয়, নিজের রাজ্যটা আবিষ্কার করে সেখানে আবার হামাগুড়ি দিতে হবে। এটাই যেকোনো সাময়িক ব্যর্থতার চূড়ান্ত বার্তা এবং এটি জীবনের আরেকটি শাশ্বত সত্য।

চতুর্থত, জীবনকে স্রেফ একটা প্রজেক্ট ভাবতে হবে। প্রতিটি প্রজেক্ট শুরুর আগে SWOT এনালাইসিস করতে হয়। SWOT বলতে: S = Strength (শক্তি), W = Weakness (দুর্বলতা), O = Opportunity (সুযোগ), T = Threat (বাঁধা বা চ্যালেঞ্জ)। প্রজেক্টের মতোই শুরুতে জীবনের উপর একটা SWOT এনালাইসিস করে নিতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে আপনার জীবনের শক্তিশালী দিকগুলো কী কী, আপনার দুর্বলতা কী কী, আপনার হাতে কী কী সুযোগ রয়েছে এবং আপনার সুযোগগুলো বাস্তবায়নে বাঁধা কোথায় কিংবা আপনার সামনে কী কী চ্যালেঞ্জ রয়েছে সেগুলো গুরুত্বের ভিত্তিতে ক্রমান্বয়ে একটি করে মোকাবেলা করে এনালাইসিস অনুযায়ী পথচলা শুরু করুন, সফল হওয়ার ক্ষেত্রে এটি জীবনের আরেকটি শাশ্বত সত্য যা বৈজ্ঞানিকভাবেও প্রমাণিত।

সর্বশেষ, জগতের একটি চিরন্তন সত্য হচ্ছে “গড-গিফটেড প্রতিভা “। প্রতিটি মানুষই আলাদা আলাদা একান্তই নিজস্ব কিছু প্রতিভা তথা শক্তিমত্তা নিয়ে জন্মায়। যেমন- কেউ ভালো গান গায়, কেউ ভালো নাচতে পারে, কেউ কবিতা লিখতে পারে, কেউ ভালো আঁকতে পারে, কেউ ভালো ক্রিকেট, ভালো ফুটবল কিংবা কেউ ভালো রান্না করতে পারে। অতএব, সবাই যে সবজায়গায় সফল হতে পারে এরূপ ভাবনা নিছক ভিত্তিহীন। এক্ষেত্রে প্রথমেই আমাদের নিজস্ব শক্তিমত্তার জায়গাটি আবিষ্কার করতে হবে তারপর সেটাকে যতভাবে সম্ভব বিশেষায়িত করার মাধ্যমে নিজেকে ঐ সেক্টরে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এ বিষয়গুলোই মূলত জীবনে সফলতার গোপন রোডম্যাপ।

মনে রাখতে হবে, সাজুগুজু করতে জানলে নারীমুখের বিশ্রী জরুলটাও যেমন বিউটিস্পটে পরিণত হয় তেমন যোগ্যতার প্রমাণ দিতে পারলে অচিরেই আমাদের খুঁতগুলো জীবনের মূল্যবান নিখুঁত সাফল্যে পরিণত হয়।।

লেখক-
নবী হোসেন মাছুম
স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর