Homeমতামতউপ-সম্পাদকীয়মুক্তবাজার অর্থনীতির কবলে বাগমারার কৃষিখাত

মুক্তবাজার অর্থনীতির কবলে বাগমারার কৃষিখাত

আগের দিনের লোকেরা বলতো, ‘বিলের নাম বিলসতি- বিলে গেলেই আধা পেটি!’ বাবাদের কাছে গল্পে শুনতাম সম্পদে এক সময় ভরা ছিল বিলসতির বিল। সেখানে ছিল ভাট, শাপলা, পদ্মমুলাম আবার ছিল শোল, বোয়াল, গজারসহ নানা জাতের দেশী মাছ। বর্ষাকালে সারা বিল পানিতে ভর্তি, মাছের গাব-গুব শব্দ, জেলেদের পাল তোলা নৌকা, বাচ্চাদের ডুব সাঁতার আরও কত কী! শুকনো মৌশুমে মাঠ ভরা সবুজের সমারাহ, কৃষকের গানে মুখরিত সারা মাঠ। কৃষানীরা কাকে কলসি আর মাথায় ভাতের গামলা নিয়ে ধান ক্ষেতের আইল বেয়ে হেটে যাওয়া, বাচ্চাদের লুকো-চুরি খেলা! এসবই ছিল বিলসতির বিলের হাজার বছরের সংসার। এই সুখের সংসারে থাবা মেরেছে পুঁজিবাদের নগ্ন শরীর! পুঁজির দখলে চলে গেছে বিলের জল, মাছ,জমি সবকিছূ। গ্রাস করেছে কৃষকের গান, সবুজের স্বপ্ন, মুখের হাসি, কাদা মাখা শরীর, ছেলে-মেয়েদের লুকো-চুরি খেলা। কাজ হারিয়ে হাজার কৃষক গ্রাম থেকে শহরে কেউবা আবার দেশের বাহিরে পাড়ি জমিয়েছে জীবিকার তাগিদে। ব্যাংক লোন, এনজিও লোন, দাদন ব্যবসার কবলে এলাকার সাধারন খেটে খাওয়া কৃষকেরা। যে কৃষি ছিল পরিবারের উপার্জনের প্রধান উৎস, সেই কৃষিখাত ধ্বংস করেছে এলাকার নব্য মুদসুদ্দিরা, উবৃত্ত ধান উৎপাদনকারী বাগমারা/রাজশাহী এখন আমদানি নির্ভর অঞ্চলে পরিনত হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষির অবদান অফুরান। এখনো কৃষি র্নিভর পরিবারের সংখা সরকারি হিসাবে শতকরা প্রায় ৫০ ভাগ যদিও এই সংথ্যা ৮০ ভাগের কম হবে না।

কৃষির উপর র্নিভর করেই যাদের জীবন জীবিকা পরিচালিত হয় আমরা তাদের পা ফাটা বলে আন্ততৃপ্তির ঢেকুর তুলি মধ্যবিত্ত কুলাঙ্গারের দল। একদিকে কৃষকদের প্রতি লোক দেখানো সরকারি ভালবাসা অন্যদিকে বিভিন্ন বিদেশী তাবেদারদের আগ্রাসন মাঝখানে কৃষকদের পৃষ্ঠ হবার অবস্থা। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশী আবাদি জমির পরিমান রাজশাহী জেলায়। উত্তর বঙ্গের শস্য ভান্ডার গুলোর মধ্য রাজশাহীর অবদান অসামান্য। এই জেলায় মোট আবাদি জমির পরিমান ১ লাখ ৮৫ হাজার ৬৬৬ হেক্টর প্রায়। এর মধ্য আবাদযোগ্য পতিত জমির পরিমান প্রায় ৯৩১ হেক্টর। এক ফসলি জমির পরিমান ৩৮ হাজার ৯১০ হেক্টর, দুই ফসলি জমি ৪২ হাজার ২৩৫ হেক্টর, তিন ফসলি জমি ১ লাখ ৩ হাজার ২৪০ হেক্টর, চার ফসলি জমি ৩৫০ হেক্টর, তাহলে নিট ফসলি জমির পরিমান ১ লাখ ৮৪ হাজার ৭৩৫ হেক্টর। আয়তনের দিক দিয়ে ধরতে গেলে বাগমারা উপজেলা রাজশাহী জেলায় সবচেয়ে বড় উপজেলা। এই উপজেলার আয়তন প্রায় ৩৬৭ বর্গ কি.মি। ফলে জমির পরিমানও এখানে বেশী। এখানে এক ফসলি জমির পরিমাণ ৩২২০ হেক্টর আর তিন ফসলি জমির পরিমাণ ১৫১০৫ হেক্টর। বুঝতেই পারছেন বাগমারার অধিকাংশ জমিই তিন ফসলি।

একদিকে ধান চাষের জন্য বিখ্যাত অন্যদিকে আলু উৎপাদনেও অন্যতম। পেঁয়াজ, রসুন এবং সব্জির জন্য বিখ্যাত এই উপজেলা। ১৯টি নদ-নদী এবং ২০টি বিলে ঘেরা এই উপজেলা! পুঁজির ধর্ম হচ্ছে লাভের পিছনে ছুটে চলা। পুঁজি যখন লাগাম ছাড়া হয়ে যায় তখনই সে ফটকার রুপ ধারন করে। কোথাও ৩০০% লাভের আশা দেখলে মৃত্যু হতে পারে এটা জেনেও মানুষ সেখানে বিনিয়োগ করতে পিছুপা হয়না এটায় পুঁজির ধর্ম। ধান চাষে লাভ কম ঝুকি বেশী কৃষকের জন্য। বরাদ্দ সরকারি অনুদান চলে যায় সরকারি দলের মাস্তান,টাউট,বাটপারদের হাতে। হাটে হাটে সরকারি ক্রয় কেন্দ্র না থাকবার ফলে কৃষক তার নায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হয় হারবার। সরকারি যে গোডাউন আছে সেটাও সরকারি দলের মাস্তান টাউটদের দখলে। ফলে সেখান থেকেও কৃষকদের কিছুই পাবার আশা নেই। বিএনপি আমলে যা দেখেছি আওয়ামীলীগ আমলেও একই ঘটনা দেখছি এখানে এই বড় দুই দলের নীতিগত কোন পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। বরং এই সরকারের আমলে বিল দখলকে কেন্দ্র করে দু গ্রুপের মধ্য বেশ কিছু সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে বাগমারায়!

ফসলের চাষের জন্য বীজ, কীটনাশক, নানা ধরনের উপকরন খুব সহজে কৃষকের পাবার কথা ছিল সেটাও দেশী করপোরেট হাউজ এবং সাম্রাজ্যবাদী বিভিন্ন কোম্পানীর দখলে চলে যাবার ফলে, কৃষক একবার বীজ কিনতে ঠকে একবার উৎপাদিত ফসল বিক্রি করতে ঠকে। পুঁজি তার নিয়ম অনুযায়ী লাভের আশায় ছুটে চলছে ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে যেখানে মুনাফার পরিমান বেশি। মাছ চাষকে কেন্দ্র করে ব্যাপক বিনিয়োগ হয়েছে এই উপজেলায়। গত এক বছরে শুধু বিহানালী ইউনিয়নে পুকুর কাটা হয়েছে ১০টির অধিক। এলাকার অনেকেরে তথ্যমতে পুরো উপজেলায় সরকারি বিধি-নিষেধ ফাঁকি দিয়ে ২০০’র বেশি পুকুর কাটা হয়েছে। গড়ে পুকুর প্রতি ৫ একর জমি হলে প্রায় এক হাজার একর জমি মাছ চাষের আওতায় চলে গেল। এর ফলে কিছু মানুষের কাছে তরল পুঁজি তৈরী হলো বটে কিন্ত তার ক্ষতির পরিমানটা কত ? এর ফলে ঐ অঞ্চলে যুগ যুগ ধরে চলে আসা জীব-বৈচিত্র ধ্বংস হলো, সার্বিক জলবায়ু পরিবর্তন হলো, মাটির মেটাবলিজ রিপ্ট ধ্বংস হলো যার প্রভাব পড়বে প্রতিটি মানুষের উপর এমন কি পুরো দেশের উপর আগামী ১৫-২০ বছরের মধ্য এর ফলাফল আমরা বুঝতে পারবো। এর ফলে হাজার হাজার কৃষি শ্রমিক কাজ হারালো, অনিশ্চিত জীবন নিয়ে ছুটে বেড়াবে এ শহর ও শহর। ঠিক একই ভাবে কৃষি জমিতে আম বাগান, লিচু বাগান, বরই বাগান আবাদি জমিকে হত্যা করছে প্রতি নিয়ত। সাথে আছে ইট ভাটা নামের পুষ্টিগুনসমেত মাটি খেকো এক দানব।

মাছ চাষের জন্য আলাদা কোন আবাদি জমিকে পুকুরে পরিনত করার প্রয়োজন আছে কি? সরকারি হিসাব কিন্তু বলে তার প্রয়োজন নেই, সরকারি হিসেব মতে দেশে যত নদী –নালা, খাল-বিল আবাদ অযোগ্য জলাশয় আছে শুধু সেখানে মাছ চাষ করলে ৩০ কোটি মানুষের আমিষের চাহিদা মেটানো সম্ভব। তাহলে এমন করে আবাদি জমি নষ্ট করবার কারণ কি? কারণ হচ্ছে পুঁজিবাদ, মুক্তবাজার অর্থনীতি, মুদসুদ্দি দালালদের তরল পুঁজি। জগতের সবকিছুই বানিজ্যিকভাবে উৎপাদন করতে গিয়ে পুঁজিপতিরা প্রতিটি মানুষকেই বানিজ্যিক করে ফেলেছে। এর খেসারত দিতে হবে আগামি প্রজন্মকেই, হতে পারে সেটা রক্ত দিয়ে অথবা জীবন দিয়ে।

লেখক:
মতিউর রহমান মিঠু
সমাজকর্মী
মোবাঃ ০১৭১৯৪০৩৭৪৭

সর্বশেষ খবর