Homeরাজনীতিসংসদে শুধুই আওয়ামী লীগ

সংসদে শুধুই আওয়ামী লীগ

দ্বাদশ জাতীয় সংসদে সরকারবিরোধী দল বা ব্যক্তি নেই। গত রোববারের নির্বাচনে জয়ী ২৮০ জনই আওয়ামী লীগের মনোনীত ও দলটির স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। এর বাইরে নির্বাচিত ১৩ জন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটের শরিক ও মিত্র। মাত্র পাঁচজন সংসদে এসেছেন ভিন্ন দল বা মতের। তবে তাঁদের মধ্যে তিনজনকে জেতার আশ্বাস দিয়ে ভোটে আনা হয়েছে।

সদ্য অনুষ্ঠিত ভোটের ফলাফল বিশ্লেষণ এবং সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জাতীয় সংসদের সদস্যদের বিষয়ে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।

১৯৯১ সালে সংসদীয় গণতন্ত্র চালুর পর ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির একতরফা নির্বাচনে অংশ নেয়নি আওয়ামী লীগ। বাকি পাঁচটি নির্বাচনের কোনোটিতেই আওয়ামী লীগের নেতারা এবারের মতো এত আসনে জয়ী হয়নি। অর্থাৎ এবার দলটির সবচেয়ে বেশিসংখ্যক নেতা ও সমর্থক দলীয় ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য হয়েছেন, যা ২০০৯, ২০১৪ কিংবা ২০১৮ সালের নির্বাচনেও ঘটেনি।

সার্বিকভাবে নির্বাচন ভালো হয়নি। সরকার যেখানে যাঁকে জেতাতে চেয়েছে, সেটিই হয়েছে। আমার বিশ্বাস, এই নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পাবে না।

জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের

গত রোববার সারা দেশে ২৯৯টি আসনে ভোট হয়েছে। এখন পর্যন্ত ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে ২৯৮টি আসনের। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ পেয়েছে ২২২ আসন। আর দলটির স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জয়ী হয়েছেন ৫৮ জন। অর্থাৎ সংসদে আওয়ামী লীগেরই সংসদ সদস্য হচ্ছেন ৯৪ দশমিক ৩০ শতাংশ।

মাদারীপুর-৩ আসন থেকে তাহমিনা বেগম এবং হবিগঞ্জ-৪ আসন থেকে সৈয়দ সায়েদুল হক স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জয়ী হয়েছেন। গতকাল সোমবার তাঁরা দুজনই প্রথম আলোকে বলেছেন, সংসদে তাঁরা আওয়ামী লীগের পক্ষেই থাকবেন। ভিন্ন কিছু ভাবার সুযোগ নেই।

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদের একজন করে দুজন জয়ী হয়েছেন। তাঁরা আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীক নৌকা নিয়ে ভোট করেন। এবার জাতীয় পার্টিকে (জাপা) ২৬টি আসন ছেড়ে দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। এর মধ্যে জাপা ১১টি আসনে জয়ী হয়েছে। দলটি ২০০৮ সাল থেকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে নির্বাচনে অংশ নিয়ে আসছে। সে হিসেবে বলা যায়, আগামী সংসদের ২৯৩ জন সদস্যই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অংশীদার।

এরপরের তিনটি নির্বাচনে ভিন্ন ভিন্ন কৌশল নিয়ে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়েছে বলে আলোচনা আছে। ২০১৪ সালে বিএনপিসহ বিরোধী দলের বর্জনের নির্বাচনে সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় ১৫৩ আসনে আওয়ামী লীগ ও দলটির মিত্ররা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়।

সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র বলছে, নির্বাচনে দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী রাখা এবং ভিন্ন দল বা মতের তিনজনকে জিতিয়ে আনা—এসব কিছুই পরিকল্পনামতো হয়েছে। মিত্রদের সঙ্গে আসন সমঝোতা থেকে শুরু করে ভোটের প্রচার এবং নির্বাচনের দিন তা বাস্তবায়নে প্রভাবশালী বেশ কয়েকটি মহল কাজ করেছে। এমনকি কোথাও কোথাও আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ কোনো কোনো নেতা হেরে যাচ্ছেন জেনেও কোনো হস্তক্ষেপ করা হয়নি। শুরুতে ভিন্ন দল ও মতের আরও বেশ কিছু প্রার্থীকে জিতিয়ে আনার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু শেষ দিকে এর অনেক কিছু কাটছাঁট করে দলের প্রার্থীদের জেতার সুযোগ করে দেওয়া হয়।

গতকাল রংপুরে জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের সাংবাদিকদের বলেন, ‘সার্বিকভাবে নির্বাচন ভালো হয়নি। সরকার যেখানে যাঁকে জেতাতে চেয়েছে, সেটিই হয়েছে। আমার বিশ্বাস, এই নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পাবে না।’

এই ‘স্বতন্ত্র কৌশলকে’ বিরোধী দলগুলো ‘ডামি’ নির্বাচন আখ্যা দিয়ে জনগণকে ভোটদানে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়ে প্রচারপত্রও বিলি করে।

ভিন্ন ভিন্ন কৌশল

সংসদীয় গণতন্ত্র চালুর পর ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়। তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগসহ প্রায় সব বিরোধী দল ওই নির্বাচন বর্জন করে। পরে বিএনপি দেড় মাসের মধ্যে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়। এরপরের তিনটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়। দুটিতে আওয়ামী লীগ ও একটিতে বিএনপি জয়ী হয়। অর্থাৎ ক্ষমতাসীন দল প্রতিবারই পরাজিত হয়।

এক-এগারোর পর ২০০৮ সালে দুই–তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়ী হয়ে ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে আওয়ামী লীগ।

এরপরের তিনটি নির্বাচনে ভিন্ন ভিন্ন কৌশল নিয়ে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়েছে বলে আলোচনা আছে। ২০১৪ সালে বিএনপিসহ বিরোধী দলের বর্জনের নির্বাচনে সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় ১৫৩ আসনে আওয়ামী লীগ ও দলটির মিত্ররা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এককভাবে নির্বাচিত হয় ২৩৪ আসনে।

স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করার ঘোষণা দেওয়ার পর বিএনপি তাঁকে বহিষ্কার করে। স্বতন্ত্র ভোট করলেও তিনি স্থানীয় আওয়ামী লীগের বড় অংশকেই পাশে পেয়েছেন। তাঁর জয়ের পেছনেও প্রভাবশালী মহল কাজ করেছে বলে আলোচনা আছে।

২০১৮ সালে বিএনপিসহ সব দল নির্বাচনে অংশ নেয়। আওয়ামী লীগ একা ২৪৮ আসনে জয়ী হয়। ওই নির্বাচনকে ‘রাতের’ ভোট হিসেবে আখ্যা দিয়ে থাকে সরকারবিরোধী দলগুলো। ভোটের আগের রাতে ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্সভর্তি করার অভিযোগ রয়েছে। ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা দেওয়ার ঘটনাও ঘটে।

এবারের নির্বাচন বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো বর্জনের ঘোষণা দিলে আওয়ামী লীগ ‘স্বতন্ত্র কৌশল’ নেয়। দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা গণভবনে নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ব্যাপারে উৎসাহিত করেন। ফলে এবার আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী ছিলেন ২৬৫ জন এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী ২৬৯ জন। এই ‘স্বতন্ত্র কৌশলকে’ বিরোধী দলগুলো ‘ডামি’ নির্বাচন আখ্যা দিয়ে জনগণকে ভোটদানে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়ে প্রচারপত্রও বিলি করে।

১৯৯১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৮৮ আসনে জয়ী হয়ে সংসদে প্রধান বিরোধী দল হয়। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন নির্বাচনে ১৪৬ আসন পেয়ে জাপা ও জাসদের (রব) সঙ্গে জোট করে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৬২ আসন নিয়ে পুনরায় বিরোধী দলের আসনে বসে।

গতকাল তেজগাঁওয়ে দলীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জনগণের প্রতিনিধি। নির্বাচিত সদস্য হিসেবেই সংসদে বসবেন, তাঁদের ভূমিকা পালন করবেন। তিনি আরও বলেন, ক্ষমতাসীন দলের হয়ে ২২২ জনের জয় ইতিবাচক বাস্তবতা।

নির্বাচিত ভিন্ন পাঁচ

এবার ফরিদপুর-৩ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জয়ী হয়েছেন ব্যবসায়ী নেতা এ কে আজাদ। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন। কিন্তু স্বতন্ত্র নির্বাচন করার কারণে ভোটের দুই দিন আগে তিনিসহ দলের ১০ জনকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার কারণে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয়ভাবে কাউকে শাস্তি না দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু ফরিদপুরে ব্যতিক্রম দেখা গেল।

কক্সবাজার-১ আসন থেকে জয়ী হয়েছেন কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সাবেক সেনা কর্মকর্তা সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম। ২০০৭ সালে ইবরাহিমের নেতৃত্বে কল্যাণ পার্টির জন্ম হয়। এবারই প্রথম তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেন।

গত নভেম্বরের শেষ দিকে বিএনপি জোট থেকে বেরিয়ে ভোটে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দেন সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম। আলোচনা আছে যে প্রভাবশালী একটি মহল থেকে তাঁকে জেতানোর আশ্বাস দিয়েই ভোটে আনা হয়। প্রচার থেকে শুরু করে ভোট পর্যন্ত তাঁকে জেতাতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো হয় বলে স্থানীয় আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো জানিয়েছে।

সিলেট-৫ আসনে জয়ী হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী মাওলানা মোহাম্মদ হুছামুদ্দীন চৌধুরী। প্রয়াত ফুলতলী পীরের ছেলে হুছামুদ্দীন প্রথমবার নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয়ী হলেন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী দলের সিলেট মহানগরের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমদ।

স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে গত ৬ ডিসেম্বর হুছামুদ্দীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গণভবনে সাক্ষাৎ করেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগের সূত্র জানিয়েছে, নৌকার প্রার্থী থাকা সত্ত্বেও হুছামুদ্দীনকে জিতিয়ে আনতে সরকারের বিভিন্ন মহলের তৎপরতা ছিল। এমনকি তাঁর পক্ষে প্রচার-প্রচারণায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ, সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাদেরও নামানো হয়।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসনে জয়ী হয়েছেন সৈয়দ এ কে একরামুজ্জামান। তিনি বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ছিলেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করার ঘোষণা দেওয়ার পর বিএনপি তাঁকে বহিষ্কার করে। স্বতন্ত্র ভোট করলেও তিনি স্থানীয় আওয়ামী লীগের বড় অংশকেই পাশে পেয়েছেন। তাঁর জয়ের পেছনেও প্রভাবশালী মহল কাজ করেছে বলে আলোচনা আছে।

স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নীলফামারী–৪ আসনে জয়ী হয়েছেন ছিদ্দিকুল আলম। তিনি জাপার বহিষ্কৃত নেতা।

এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগসহ ২৮টি নিবন্ধিত দল অংশ নেয়। এর মধ্যে শুধু ৫টি দল সংসদে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। ১৯৯১ সালের পর আর কোনো নির্বাচনে এমন নজির নেই উল্লেখ করে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, এবার সংসদে সরকারকে জবাবদিহি করার মতো ভিন্নমত বা দলের উপস্থিতি সেভাবে নেই।

সর্বশেষ খবর